satsamudra.com

Logo

সাতসমুদ্রdotকম

একটি তেলবাহী জাহাজ (Photo Credit)

মার্চেন্ট নেভির জীবন। পর্ব 1

সেদিন অনেক রাতে, বম্বে থেকে জীবনের প্রথম বার প্লেনে চাপা, বম্বে তখনও মুম্বাই হয়নি, সেটা হয়েছিল উনিশশো-পঁচানব্বই সালে। পরদিন সকালবেলা Dubai পৌঁছনোর পর, Airport থেকে Breakfast এর জন্য আমাদের একটা বড়োসড়ো হোটেলে নিয়ে যাওয়া হলো। খাওয়া-দাওয়ার পর শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাসে চেপে আমরা সবাই, Dubai থেকে প্রায় 130 Km দূরের শহর, Fujairah র উদ্ধেশে রওনা হলাম, ছোট্ট সুন্দর বাসটা আমাদের জন্যই ভাড়া করা হয়েছিল। অসম্ভব স্পীডে বাসটা একনাগাড়ে এক্সপ্রেস হাইওয়ের ডানদিকের রাস্তাটা ধরে ছুটতে লাগলো, ভারতে আমরা বাঁ দিকের রাস্তা ধরে চলি, এখানে তার ঠিক উল্টোটা। এই Left-hand traffic এবং Right-hand traffic এর কথা আমি আগে শুনেছিলাম। একটা বিদেশী জাহাজ কোম্পানিতে Cadet বা Trainee Officer হিসাবে চাকরি পেয়ে, আমি বম্বেতে মাস তিনেকের Training’এর পর, Dubai হয়ে Fujairah যাচ্ছি জাহাজ Join করতে।

যে সমস্ত দেশ Left-hand Traffic ব্যাবস্থার অন্তর্গত সেখানে Right-hand Drive গাড়ি ব্যবহার হয়, যেমন আমাদের ভারতবর্ষ, আবার Right-hand Traffic এর দেশে Left-hand Drive গাড়ি ব্যবহৃত হয়, যার উদহারণ আমেরিকা। এর উল্টো হলে, সেই সমস্ত গাড়ি চালানোর জন্য কতৃপক্ষর কাছ থেকে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন পরে। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ, প্রায় 65%, RHT অর্থাৎ আমেরিকান সিস্টেম অনুসরণ করে। দেশগুলি তাদের Colonial Legacy বা উপনিবেশকালীন সময়ের প্রভাবে অথবা নিজেদের ইতিহাসের ভিত্তিতে বা বিভিন্ন অন্য কারণে তাদের উপযুক্ত ব্যবস্থা বেছে নিয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে সারা পৃথিবীতে সমুদ্রগামী জাহাজ আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে Right-Hand Traffic Rule মেনে চলে। আবার জাহাজেও Steering Wheel থাকে এবং Wheelhouse বা Bridge’ এর Steering Wheel এর অবস্থান সবসময় Centerline বা জাহাজের মাঝ বরাবর হয়। 

1990 সালের ভারতবর্ষ। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজবাবস্থা, মুদ্রাস্ফীতি এবং বাজারদর, দেশ এবং দশের অনিশ্চিত ভবিষৎ ইত্যাদি সূক্ষ বিচারে আজগের থেকে আলাদা হলেও, হরেদরে সেই একই। তবেকি সময়টাকে উপলব্ধ টেকনোলজির ভিত্তিতে বিচার করে দেখলে অনেক তফাৎ দেখা যাবে।  মোবাইল ফোন অথবা Internet, Wifi, cable TV, Satellite TV, এসব যে কি, সে ব্যাপারে মদ্ধবিত্ত বাঙালির তখন কোনো ধারণাই ছিল না।  আর যেটা আশেপাশে কোথাও নেই সেটা লোকে জানবেই বা কিভাবে, আজকের মতো Google বা AI কিছুই নেই, যে বাড়িতে বসে কিছু জানা যাবে। কম্পিউটার জিনিসটা আদৌ মানব সভ্যতার বড় কোনো কাজে আসবে কিনা সেটা বাস্তবিকই তখন ভারতবর্ষে একটা তর্কের বিষয়, এই Computer নিয়ে রাজনৈতিক বিক্ষোভের নজিরও আছে, যে কম্পিউটারকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। অনেকটা আজকের দিনের Cryptocurrency ‘র মতো, লোকে কমই বোঝে কিন্তু বিশ্বজোড়া তার অস্তিত্ব, অজানা ক্ষমতা লুকিয়ে আছে ভবিষতের অন্ধকারে।    

তবে ব্যায়বহুল হলেও মদ্ধবিত্তের নাগালে কিছু জিনিস ছিল, যার জোরে জীবন আজকের দিনের থেকে বহু দূরে বোধহয় ছিল না। যেমন ঘরে বসে সিনেমা দেখার জন্য VCR (Video Cassette Recorders), STD (Subscriber Trunk Dialing) বা ISD (International Subscriber Dialing), ব্যায়বহুল হলেও এদেশ থেকে বিদেশে ফোন করা যেত। Email না থাকলেও পোস্ট অফিস থেকে telegram করা যেত, বা দেশ বিদেশে সহজেই চিঠি পাঠানো যেত। আর তেমন কাজের উপযোগী নাহলেও পাড়ায় Computer শেখার স্কুলে পাওয়া যেত Microsoft Windows বা Microsoft Excel বা Word। সে যুগে MS-DOS operating system এর ওপর Windows আলাদা একটা Application হিসাবে load করে তবে Graphical User Interface (GUI) পাওয়া যেত, আর তাতে Mouse চলতো। উনিশশো-পঁচানব্বই সালে Windows, Operating System’এর অংশভুক্ত হয়। আর ছিল Floppy Disk এবং Computer Virus, সেই Virus আসল Virus কিনা তা নিয়েও তক্কাতক্কি লেগে যেত। তবে তাতে কি? ভুল তথ্যের আজকের দিনেই বা অভাব কোথায়? আজ যেটা সত্যি, কাল সেটা মিথ্যা, এমন জিনিসের চিরকালই ছড়াছড়ি। ভারতের Economic Liberalization তখনও শুরু হয়নি, এবং Information Technology (IT) বা তথ্য প্রযুক্তির যুগ তখন সদ্য প্রসূত। সরকারি বাদ দিলে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের রমরমা নেই বললেই চলে। ওদিকে পশ্চিবঙ্গের সেই দৃষ্টান্তমূলক রাজনৈতিক ইতিহাস, ইত্যাদি ইত্যাদি।

Sheikh Zayed Road in 1990, Dubai
Dubai Skyline (Now)
Sheikh Zayed Road, Dubai (Now)

তখনকার Dubai আর আজকের Dubai ছিল অনেক আলাদা, কিন্তু সবকিছুই আপেক্ষিক, আমার মফস্বলি কলকাতা দেখা চোখে মুম্বাই যেমন তখন স্বপ্ননগরী, আর মুম্বাই’এর তুলনায় Dubai সম্পূর্ণ আলাদা স্বাদের । আমার অনভিজ্ঞ অনুভূতিও Dubai’তে Petrodollar এর উপস্থিতি টের পাচ্ছিলো, এ যেন এক অন্যরকম বড়লোকি স্বাদ। চওড়া চওড়া রাস্তা, অগুনতি ধাঁ-চকচকে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, আর সবথেকে চিত্তাকর্ষক হলো রাস্তা ভর্তি Left Hand Drive বড়োবড়ো দামী বিদেশী গাড়ি, কলকাতাতে যা দুর্লভ আর মুম্বাই শহরের সেকালের বিখ্যাত অফিস পাড়া, Nariman Point অঞ্চলেও তখন খুব কমই বিদেশী গাড়ি দেখা যেত। ভারতে তখন Ambassador, Contessa আর Premier Padmini বা 118NE ছাড়া Mahindra র Jeep, এবং Maruti আর Tata কোম্পানির মাত্র একটা দুটো মডেলের গাড়ি তৈরী হতো। 

Dubai তখন একটা দ্রুত পরিবর্তনশীল শহর, একটা ব্যস্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র। আজকের দিনের Dubai শহরের আইকনিক ল্যান্ডমার্কগুলো, যেমন  Burj Khalifa, Palm Jumeirah, Burj Al Arab, Dubai Mall, Dubai Fountain, Museum of the Future, Dubai Frame & Global Village  ইত্যাদির, তখন পরিকল্পনা চলছে বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে তৈরী হওয়ার কাজও শুরু হয়ে গেছে, 39-তলা Dubai World Trade Centre সেইসময় সহরের সবথেকে উঁচু Building এবং বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক। Shipping Industry’র ক্ষেত্রে, বিভিন্ন কারণে Dubai বিশ্ব-বাজারে, একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হিসাবে আগে থেকেই পরিচিত ছিল। তার অনেকগুলো কারণও ছিল, যেমন

— ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে  Persian Gulf ‘এর ঠিক শুরুতে অবস্থিত হবার কারণে, Qatar, Bahrain, Saudi Arabia, Kuwait, Iraq বা Iran এর মতো পৃথিবীর বিখ্যাত Oil Exporting দেশগুলো থেকে Crude Oil জাহাজে Load করার জন্য, পৃথিবীর সবথেকে বড়ো এবং অত্যাধুনিক Oil Tanker Ship গুলো Dubai শহরের পাশ দিয়ে যাতায়াত করতে বাধ্য। আবার জায়গাটি Suez Canal Shipping Traffic এর অত্যন্ত কাছে অবস্থিত, এই Suez Canal এর মাধ্যমে এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে অসংখ্য জাহাজ চলাচল করে। Dubai জায়গাটি এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপেরও একপ্রকার ভৌগোলিক কেন্দ্রে অবস্থিত, এই কারণে জায়গাটি জাহাজের Transshipment Port এবং এরোপ্লেনের Transit Airport হবারও উপযুক্ত।                                                  

— United Arab Emirates (UAE) দেশের সাতটা Emirate ‘এর নাম, Abu Dhabi, Dubai, Sharjah, Ajman, Umm Al Quwain, Ras Al Khaimah এবং Fujairah ।  Arabic ভাষায় শাসক বা Ruler কে Emir এবং Emir দ্বারা শাসিত রাজ্যকে Emirate বলা হয়। Dubai দেশটিতে প্রভূত খনিজ তেল আর গ্যাস সম্পদের সম্ভার রয়েছে। দেশের সম্পদের সঠিক বিনিয়োগ করে  Dubai, বিশ্বমানের Seaport এবং Airport, Transshipment Port, Warehouse, Logistics, Ship Building and Repairing Industry, Ship Chandler services, Clearing & Forwarding, Insurance, Banking ইত্যাদির উন্নত পরিকাঠামো প্রদানের মাধ্যমে, সারা পৃথিবীর Shipping Industry’র একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।

চারদিকে ধুধু করছে শুধু বালি আর বালি, আমার অবশ্যই সেই প্রথম মরুভূমি দেখা। কিন্তু দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমির মধ্যে, রাস্তার Divider এর ওপর কিলোমিটারের এর পর কিলোমিটার নানান ফুলের গাছ দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম, এইসব গাছ কি করে জল ছাড়া বেঁচে থাকে? পরে জেনেছিলাম যে ওখানে জল দেবার জন্য Perforated Pipe পাতা আছে, সময় সময় বহু দূর থেকে Pump ব্যবহার করা হয়, আর ওই পাইপের অসংখ্য ফুটোগুলো থেকে গাছের গোড়ায় জল আসে। Fujairah পৌঁছে আমরা সবই একটা Speed Boat’এ চেপে জাহাজে এলাম। Crew দের Sign On / Sign Off’এর জন্য ব্যবহৃত এই প্রকার Vessel কে Crew Boat’ও বলা হয়। বিশাল জাহাজটা জেটি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে, Fujairah পোর্টের Anchorage Area’তে  Anchor করে দাঁড়িয়ে ছিল। 

UAE দেশের সাতটি Emirate এর  মধ্যে Shipping Industry র ক্ষেত্রে Fujairah জায়গাটির বিশেষ গুরুত্ব আছে। Gulf of Oman এ অবস্থিত হবার কারণে, Fujairah‘র ভৌগোলিক অবস্থান Suez Canal Shipping Traffic এর আরো কাছে। Strait of Hormuz পেরিয়ে Dubai পর্যন্ত না গিয়েও জাহাজগুলো এখন থেকে তাদের প্রয়োজনীয় সমস্ত Supply, Service বা Crew পরিবর্তন ইত্যাদি করার সুযোগ পায়। Fujairah Port একটি প্রাকৃতিক বন্দর বা Natural Harbor, যার মানে, এই অঞ্চলের সমুদ্রের জলের গভীরতা জাহাজ চলাচলের জন্য উপযুক্ত এবং জায়গাটা, প্রবল সামুদ্রিক হাওয়া বা জলের স্রোত, উঁচু ঢেউ ইত্যাদির থেকে প্রাকৃতিক ভাবে সুরক্ষিত। এর সাথেসাথে সরকারি সমর্থনে তৈরী উপযুক্ত পরিকাঠামো, অল্প ট্যাক্স বা শুল্কের সুবিধা ইত্যাদি তো আছেই। অজস্র রুক্ষ পর্বতমালা, নিখুঁত সমুদ্র সৈকত থাকার কারণে প্রকৃতি এবং অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীদের কাছেও , Dubai শহরজীবন থেকে একটু দূরে, Fujairah একটি জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল। 

সেই সময়টা আমার জীবনের বড়ো আনন্দের, আমরা সবাই ভারতীয়, যদিও ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের লোক এখানে। Captain এবং Chief Engineer, যারা Deck এবং Engine Department এর যথাক্রমে প্রধান, ওনারা দুজন, দিন পনেরো আগেই মুম্বাই থেকে প্লেনে করে South Africa র Cape Town’এ গিয়ে জাহাজটাতে Join করেছিলেন। ওনারা যাতে কাজকর্ম ঠিকঠাক বুঝে নিতে পারেন সেই জন্য আগে এসেছিলেন। খালি জাহাজটা তখন Cargo Load করার জন্য Europe থেকে Persian Gulf এর  দিকে আসছিলো। ঠিক ছিল যে আমরা অর্থাৎ অন্যরা যেদিন Join করবো সেই দিনই পুরোনো Crew চলে যাবে। শুধু পুরোনো Swedish Chief Officer পরবর্তী Loading Operation শেষ হওয়া অবধি থাকবে, যদি কোনো কারণে তাকে আমাদের দরকার পরে, এই জন্য। বম্বে এয়ারপোর্টে শুনেছিলাম যে এই প্রকান্ড Tanker Vessel টা আমাদের Company একটা Swedish Company থেকে Takeover করছে। 

একটা Company থেকে যখন কোনো জাহাজ অন্য Company তে হস্তান্তরিত হয়, তখন তার সম্পূর্ণ দ্বায়িত্ব পরিবর্তনকে Takeover বলা হয়। জাহাজের প্রত্যেকটি Crew, যারা Sign Off করছে, তারা সেই Rank ‘এর  প্রত্যেক নতুন আসা Crew কে , অর্থাৎ যারা Sign On করছে, তাদের সমস্ত কাজ বুঝিয়ে, তবে Sign Off করে। Officer’দের ক্ষেত্রে লিখিত Handing Over Report দিতে হয়। এই Sing On এবং Sign Off প্রক্রিয়া, পরিস্থিতি অনুযায়ী কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত হতে পারে। আবার Takeover Vessel এর ক্ষেত্রে যখন সমস্ত Crew একই সাথে পরিবর্তন হয়, তখন এর গুরুত্ব আরো বেশি হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণ ক্ষেত্রে Sign Off এবং Sign On এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয় যাতে কোনো Department’এ একসাথে বেশি লোক পরিবর্তিত না হয়।

আগের Crew রা সবাই Sweden দেশের নাগরিক ছিল। জাহাজের মালিকও ওদের দেশেরই, Hong-Kong এর একটা কোম্পানি জাহাজটার Management এর দ্বায়িত্ব নিয়েছে, আর আমরা Hong-Kong এর কোম্পানিতে বম্বের Agent Company দ্বারা নিযুক্ত কর্মী। ব্যাপারটা আসলে জটিল, জাহাজের ব্যবসা আদপে বড়োই জটিল, এই ব্যাবসায় অনেক পক্ষ জড়িত থাকে।   

আসার সময়, বম্বে এয়ারপোর্টে আমাদের দলে, Deck Department’এর পদমর্যাদার দিক থেকে সর্বোচ্ছ ছিল Chief Officer আর Engine Department’এর সর্বোচ্ছ Second Engineer, বাকি সবাই এদেরকে স্যার বলে বেশ সম্মানের সাথে সম্মোধন করছিলো। এদের ওপরেই Captain এবং Chief Engineer , যারা আগে থেকেই জাহাজে উপস্থিত। আমি জানতাম যে এই Chief Office ই আমার Boss, Cadet হিসাবে জাহাজে এর অধীনে আমাকে কাজ করতে হবে, একেই আমি সবসময় Report করবো। আমার সাথে বাকি সবাই স্বাভাবিক ব্যবহার করলেও, Deck Department , মানে আমার নিজের ডিপার্টমেন্টের তিনজন অফিসার, অর্থাৎ Chief Officer, Second Officer এবং Third Officer, দূরত্ব বজায় রেখে চলছিল।

Shipboard Organizational Chart

জাহাজে Cadet এর জীবন যে সুখের নয় এবং কঠোর পরিশ্রমের, তা আমি শুনেছিলাম, কিন্তু শরীর আর মনের ওপর তার যে কি প্রভাব সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। Work Culture, Positive Work Culture,Toxic Work Culture, Command Culture, Hybride Command Culture এসব যে কি বা  পরিশ্রম যে কোথায় অত্যাচাররে পরিণত হতে পারে, সদ্য কলেজ থেকে Pure Science এ Graduation করে মধ্যবিত্ত বাঙালি হিসাবে, আমার হয়তো এসব কিছু সেই বয়সে জানার কথা ছিল না। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতি, সমাজ, ঐতিহাসিক যুগ বা ঐতিহাসিক ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখার আমার কোনো জ্ঞান নেই, সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে মানুষের জটিল চরিত্র সম্পর্কে জানা বা তা বিশ্লেষণ করার কোনো ক্ষমতা নেই। যুক্তিবিজ্ঞান আমি কিছুই বুঝিনা, পেশাদার জীবনের প্রয়োজনীয় সহনশীলতা এবং ধৈর্য বা সেক্ষেত্রে যুক্তিযুক্ত চিন্তাভাবনা করা বা মানসিক সমস্যা সমাধানের উপায় খোঁজা, এসব নিয়ে আমি জীবনে কখনো ভাবিনি। আবার বিশ্বব্যাপী দুর্বল মানুষের সবলের হাত থেকে বেঁচে থাকার জন্য গভীর বোঝাপড়া বা মেনে নেওয়া, গণতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে আসল বা নকল সরকার এবং নাগরিক অধিকার, আইনের শাসন বা অপশাসন এসব নিয়ে আমি কখনো চিন্তাও করিনি, তাই জটিল মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের কৌশল আমার জানা নেই। আমার শিক্ষাদীক্ষা যে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক ছিল তা নয়, কিন্তু তাকে বাস্তব-বিশ্বের সমস্যার সাথে তুলনা করে দেখে আরও প্রাসঙ্গিক এবং অর্থপূর্ণ করার কোনো সামাজিক বা পারিবারিক সংগঠিত উদ্যোগ নিশ্চয়ই ছিল না। তাই হঠাৎ এতবড়ো পৃথিবীকে একা face করার মতো ক্ষমতা বা Maturity আমার ছিলোনা বলা চলে। সেই মুহূর্তে, আমি ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া একটা চড়কি মাত্র।

কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের Crew Boat টা জাহাজের কাছে পৌঁছে গেল। জাহাজে ওঠার ব্যবস্থা দেখে আমি বেশ ঘাবড়ে গেছিলাম, প্রথমেই প্রায় 20-25 feet উঠতে হবে একটা দড়ির মোই বেয়ে, তারপর একটা Aluminium এর সিঁড়ি,  যাকে Gangway বলে, তাই দিয়ে আরো 30-40 feet ওঠার পর তবে জাহাজের Main Deck এ পৌঁছনো যাবে। এই রকম ব্যাবস্থাকে Combination Ladder বলে। Gangway সিঁড়ির মতো হওয়ায়, সেটা দিয়ে ওটা শক্ত নয়, শুধু পা পিছলে পরে না গেলেই হলো, কিন্তু দড়ির মোই বেয়ে ওঠাটা শক্ত এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, কারণ নিচে সমুদ্রে পরে গেলে বা সরাসরি নিচে দাঁড়িয়ে থাকা Boat টার ওপর পড়লে, বাঁচা বা মরা নিঃসন্দেহে ভাগ্যের হাতে। 

Combination ladder (Photo Credit)

Gangway দিয়ে উঠে প্রথম যখন Deck এ পা রাখলাম, দেখলাম কয়েকজন সাহেবদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ভারতীয়কে সবাই সসম্মানে অভিবাদন জানিয়ে তারপর Accommodation Superstructure এর দিকে যাচ্ছে। বুঝলাম ইনিই আমাদের Captain , আমিও তাই করলাম। উনি সবাইকেই জিজ্ঞেস করছিলেন যে তারা কোন Rank’এ join করছে এবং তাদের নাম কি? আমাকেও জিজ্ঞেস করলেন। 

মস্ত বড়ো Accommodation Superstructure’এর পেছনের দিকে, যে Swedish Crew রা Sign Off করবে তাদের কয়েকজন ব্যাস্ত ভাবে একটা অপেক্ষাকৃত ছোটো Crane’এর সাহায্যে আমাদের স্যুটকেসগুলো Crew Boat থেকে জাহাজের ওপর তুলছিলো, জাহাজের পেছনের দিকের Deck এ অবস্থিত, এই প্রকার Crane গুলোকে সধারনত Provision Crane বলা হয়। ওরা সাথে সাথে নিজেদের স্যুটকেসও Boat টাতে নামিয়ে দিচ্ছিলো। আমি আমার স্যুটকেসটা নিয়ে কয়েকজনের সাথে Accommodation এর ভেতরে গেলাম, ভেতরটা কনকনে ঠান্ডা ।  সিঁড়ি দিয়ে কয়েকটা Deck উপরে উঠতেই পর পর সারি দেওয়া অনেক কেবিন। আমাদেরই একজন, যাকে জাহাজে Bosun বলা হয়, সে আমাকে আমাকে একটা খালি কেবিনে বসতে বললো।  বললো ওখানে অপেক্ষা করতে, আমাকে পরে ডাকা হবে। 

Officer Rank এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না হলেও, Bosun জাহাজের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ, এই পদে সবসময় একজন অভিজ্ঞ এবং দক্ষ নাবিককে নিযুক্ত করা হয়, সে Deck Crew দের প্রধান এবং সরাসরি Chief Officer কে Report করে। আক্ষরিক অর্থে Crew বলতে জাহাজে কর্মরত Officer এবং Non-Officer উভয়কেই বোঝায়। কিন্তু Deck এবং Engine উভয় Department’এই, ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে Non-Officer দের, Crew বা Seaman বা Ratings বলে অভিহিত করা বহুল প্রচলিত।

কিছুক্ষনের মধ্যে সবই যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলো, পাশের কেবিনে যারা ছিল তাদের দেখতে পেলাম না, এদিক ওদিক উঁকিঝুঁকি মেরেও কাউকে দেখতে পেলাম না।  একবার Accommodation এর বাইরেও গেলাম, সেখানেও কেউ নেই, বুঝলাম যে Swedish Crew রা ততক্ষনে সব চলে গেছে, অগত্যা ফিরে এসে কেবিনেই বসে রইলাম। কেবিনের Porthole দিয়ে একবার দেখলাম, প্রকান্ড Main Deck টাতে আমাদের কয়েকজন ব্যাস্ত ভাবে চলাফেরা করছে। কেবিনের বন্ধ করা কাঁচের ছোট ছোট জান্লাকে Porthole বলে, এগুলো সাধারণত গোলাকার হয়। এইভাবে তখন ঘন্টা খানেক কেটে গেছে, হঠাৎ জাহাজটা একটু দুলে উঠলো, তারপর ক্রমাগত হালকা ভাবে দুলতে লাগলো, Porthole দিয়ে দেখে বুঝলাম Fujairah’র Shore Line এর সাপেক্ষে আমরা একটু একটু করে এগোচ্ছি, আমার জীবনের Seafaring সেইখানে শুরু হয়েছিল। 

তখনও দিনের আলো শেষ হয়নি, আমি কালো প্যান্ট, সাদা জামা, আর কাঁধে Cadet এর Epaulette , অর্থাৎ আমাদের Uniform পরে কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ট্রেনিংএর সময় আমরা জেনেছিলাম যে কেবিন থেকে বেরোলেই ইউনিফর্ম অথবা Boilersuit পরে থাকতে হবে। আবার উপযুক্ত কাজের জন্য ছাড়া Boilersuit পরা যাবে না, অর্থাৎ ইউনিফর্মই পরে থাকতে হবে। Dress Code’এর বিধিনিষেধ কোম্পানির নীতির ওপর নির্ভর করে, অনেক কোম্পানি এক্ষেত্রে যথেষ্ট উদাসীন, কিন্তু আমাদের কোম্পানি তা নয়। Accommodation এর বাইরে Main Deck এ এসে Port Side ধরে একা একা হাঁটতে থাকলাম। অসীম নীল সমুদ্রের মধ্যে গোধূলিলগ্নের সেই অপার্থিব সৌন্দর্যে আমার মন ভোরে গিয়েছিলো। কিন্তু জাহাজে Duty Officer এর অনুমতি ছাড়া একা Main Deck’এ যাবার অনুমতি নেই। Duty Officer অবশ্যই আমাকে Bridge থেকে Main Deck’এ হাঁটতে দেখেছিল, কিন্তু কিছু বলেনি, Bridge’এর একদম ওপরে Public Address System’এর মাইক আছে, তাতে কিছু বললে জাহাজের শেষ প্রান্ত অবধি শোনা যায়, ও ইচ্ছে করেই কিছু বলেনি, শুধু নজর রেখেছিল, অর্থাৎ আমার অজান্তে আমার অপরাধের তালিকা তৈরী শুরু হয়ে গেছিলো। Bosun আমাকে কেবিনের Porthole দিয়ে দেখেছিল, ও Accommodation এর বাইরে এসে দূর থেকে আমাকে ডেকে Dinner করতে Officer Mess Room এ যেতে বললো। 

Dinner করার সময় 1800-1900 Hrs, এই নিয়মটা মোটামুটি আন্তর্জাতিক, আর পৃথিবীর সব জাহাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। জাহাজের খাবার জায়গাকে Mess Room বলা হয়। Officer এবং Crew দের Messroom আলাদা। কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী Officer রা তাদের নির্ধারিত Uniform পরে তবেই খাবার খেতে পারবে। আর Crew দের ক্ষেত্রে সে জায়গায় Formal Dress প্রযোজ্য। এছাড়াও Duty Mess নামে আর এক প্রকার Mess Room থাকে, যেখানে Officer এবং Crew উভয়েই Boilersuit পরে খাবার খেতে পারে। Deck Officer রা তাদের Deck Work বা Maintenance Work করার সময় Boilersuit ব্যবহার করে, আর Bridge Watchkeeping Duty তে Uniform ব্যবহার করে থাকে। অন্যদিকে Marine Engineer বা Engineering Officer রা সাধারণত তাদের Watchkeeping এবং Maintenance উভয় প্রকার Duty র ক্ষেত্রেই Boilersuit ব্যবহার করে । একমাত্র Officer Messroom’এ খাবার, Steward দ্বারা পরিবেশিত হয়।

কোনো একটি মালবাহী জাহাজের Galley এবং Messroom (Video Credit)

Boilersuit পরিহিত জনৈক কর্মী (Photo Credit)

আমাকে দেখতে পেয়ে একজন Steward একটা নিদিষ্ট টেবিলের একটা নির্দিষ্ট চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে বললো আমি যেন সবসময় এই চেয়ারেই বসি। Rank অনুযায়ী প্রত্যেক Officer এর টেবিল এবং চেয়ার এখানে আলাদা। এই জাহাজে দুজন Steward ছিল, এদের কাজের দ্বায়িত্বের মধ্যে, রান্নার কাজ এবং পরিবেশন ছাড়াও অফিসারদের কেবিন, Galley, Mess Room, Provision Store ইত্যাদির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার কাজ অন্তর্ভুক্ত। Chief Cook এর অধীনে, এদের নিয়ে Galley Department এ এরা মোট তিন জন Crew, Chief Cook সাধারণত Captain কে Report করে । যাইহোক তখন বেশি কেউ সেখানে ছিল না, আমি তাড়াতাড়ি কিছু খেয়ে আবার কেবিনে চলে এলাম। 

জাহাজের Hull এবং Accommodation এর একএকটা তলাকে Deck বলা হয়। জাহাজের সম্পূর্ণ দেহকে দুভাগে ভাগ করলে, তার Main Deck এর ওপরের অংশটা হয় Accommodation Superstructure এবং নিচের অংশটা Hull, এই Hull অংশটাই মুখ্যু, কারণ এটাই সমুদ্রের জল অপসরণ করে জাহাজকে ভাসিয়ে রাখে। 

Accommodation এর ভেতর Crew দের এবং Officer দের কেবিনের Deck আলাদা। আমি সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করে বেশ কয়েকটা deck এ ঘুরেও কাউকে কোথাও দেখতে পেলামনা। এতগুলো লোক, সবাই যেন উধাও হয়ে গেছে। একেবারে ওপরে Bridge Deck , তখন প্রায় 19:00 Hrs., আমি জানি যে Bridge এ Chief Officer, Navigational Watchkeeping Duty তে আছে।  

একটি Passenger Ship’এর বিভিন্ন Deck’এর বিন্যাস (Photo Credit)

আন্তর্জাতিক ভাবে, Sailing এবং Anchor এর সময় Bridge’এ  , সকাল এবং সন্ধে যথাক্রমে 04:00 – 08:00 এবং 16:00 – 20:00 ঘন্টায়, Chief Officer এর duty র সময়। একই ভাবে সকাল এবং রাত্রি, 08:00 – 12:00  এবং 20:00 – 24:00 ঘন্টায়, Third Officer , আর  Second Officer এর duty র সময় হচ্ছে দুপুর এবং রাত্রি 12:00 – 04:00 , এইভাবে 24 ঘন্টাতে duty ভাগ করা। Captain এর কোনো নিয়মিত ডিউটি নেই। ঠিক এই কারণেই সারা পৃথিবীর সমস্ত জাহাজে Watchkeeping , Maintenance ইত্যাদি বিভিন্ন Duty , এবং Breakfast , Lunch , Dinner এর মতো সবকিছুর সময় একই । যদিও ঘড়ির সময় এক হলেও এতে Time Zone এর প্রভাব আছে, যা আমরা পরে আলোচনা করবো।   

আমি Chief Officer এর সাথেই দেখা করে জানতে চাই যে আমি কি কাজ করবো, কিন্তু তিনি ব্যাস্ততার মধ্যে বিরক্ত হবেন এই কথা ভেবে আমার Bridge এ যাবার সাহস হলো না। অগত্যা Bosun এর কেবিনে গিয়ে ওকে জিজ্ঞাস করবো ঠিক করলাম।

ক্রমশঃ

Sheikh Zayed Road in 1990, Dubai (Photo Credit); Dubai Skyline(Now) (Photo Credit); Sheikh Zayed Road, Dubai(Now) (Photo Credit);

Subscribe
Notify of
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
trackback
January 31, 2025 6:55 pm

[…] January 31, 2025 একটি তেলবাহী জাহাজ (Photo Credit) মার্চেন্ট নেভির জীবন। পর্ব 2 Bosun এর কেবিনে গিয়ে দরজায় টোকা দিতে ও বেরিয়ে এলো, — Bosun জি , Chief Officer সাব তো আমাকে ডাকেনি, আমি এখন কি কাজ করবো?  —… Read More […]

trackback
January 31, 2025 7:17 pm

[…] January 31, 2025 একটি তেলবাহী জাহাজ (Photo Credit) মার্চেন্ট নেভির জীবন। পর্ব 2 Bosun এর কেবিনে গিয়ে দরজায় টোকা দিতে ও বেরিয়ে এলো, — Bosun জি , Chief Officer সাব তো আমাকে ডাকেনি, আমি এখন কি কাজ করবো?  —… Read More […]

2
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x