Jetty’তে বাঁধা অবস্থায় কোনো একটি তেলবাহী জাহাজ (Photo Credit)
Bridge’এ আমার বসার অনুমতি নেই, তাই অনেক্ষন বসার সুযোগ পাইনি। কেবিনে এসে সোফায় বসে ভাবছিলাম যে রাত্রে যে কোনো সময় Loading শুরু হতে পারে, কখন যে কেবিনের Phone বেজে উঠবে জানিনা, এই অনিশ্চয়তা বাস্তবিকই অস্বস্তিকর, বেশ ক্লান্ত লাগছিলো, আমি শুয়ে পড়লাম।
কেবিনের ফোনের আওয়াজ শুনে গভীর ঘুমের মধ্যে থেকে ধড়পড় করে উঠলাম,
— Good Morning Sir, Mitra here
— মিত্র, Good Morning, জাহাজ Anchor Heave করছে, পনেরো মিনিটের মধ্যে Forward Anchor Station’এ যাও।
— Yes Sir
রাত্রি একটা বেজে দশ মিনিট। শোবার আগে একপ্রকার এটা জেনেই শুতে গেছিলাম যে রাতে যে কোনো সময় উঠতে হবে, কিন্তু তবু কেন জানিনা ফোনের আওয়াজ শুনলেই ভয় করে, একটা অপ্রত্যাশিত কিছুর ভয়, আবার কয়েক মিনিটের মধ্যে ঠিকও হয়ে যায়। ব্যাপারটা অসহ্য, কিন্তু নিঃসন্দেহে অবচেতন মনের প্রতিক্রিয়া, তাই হয়তো সচেতনতা ফিরে এলেই ঠিক হয়ে যায়। Duty AB ফোন করেছিল, এখানে রাত্রি বারোটা বা 00:00 সময়ের পর সবাই Good Morning কথাটা ব্যবহার করে, আবার দুপুর 12:00 ‘র পর Good Afternoon আর বিকেল চারটে অর্থাৎ 16:00 ‘র পর Good Evening বলা হয়। মজার কথা এই যে ভোরের আলো ফোটার আগে অবদি, বিদায় নেবার সময় সাধারণত Good Night কথাটা ব্যবহৃত হয়। এটা সঠিক না হলেও, জাহাজে এই অভ্যাস প্রচলিত।
তাড়াতাড়ি তৈরী হতে লাগলাম, বাধ্যতামূলক দাঁতব্রাশ করা, C/O যদি একবার এইসব কারণে ধরে ফেলে, তাহলে আমার কপালে অনেক দুঃখ আছে। কেবিন থেকে Boilersuit পরে বেরিয়ে তারপর Changing Room থেকে Safety Shoe পরে Forward Anchor Station’এ পৌঁছতে পৌঁছতে কুড়ি মিনিট লেগে গেলো। C/O তখনও আসেনি, বুঝলাম Duty AB হাতে কিছু সময় রেখেই আমাকে ডেকেছে, সেটা আমার পক্ষে ভালোই। Bosun, Walkie-Talkie নিয়ে Bridge’এ 2/O’এর সাথে যোগাযোগ রাখছিলো। C/O আসতে ব্যাস্ততা অনেক বেড়ে গেলো, Bridge থেকে ক্যাপ্টেন-সাব Walkie-Talkie’তে আদেশ দিতেই বিশাল Windlass ব্যবহার করে Anchor Heaving শুরু হলো এবং প্রায় আধঘন্টা বাদে C/O, Anchor Sighted, অর্থাৎ Anchor’কে জলের ওপর দেখা গেছে, বলার পর, জাহাজ আস্তে আস্তে এবার Port’এর দিকে চলা শুরু করে দিলো। ওদিকে Arrival Mooring Station ডাকা হয়ে গেছে, Forward এবং Aft Station’এ Crew’রা ততক্ষনে সবাই এসে গেছে, C/O একটা Bollard’এর ওপর বসে পড়ে আমাকে বললো,
— Cadet , যাও, ভালো করে এক কাপ Coffee বানিয়ে নিয়ে এসো
— Yes Sir
আমি সুদূর Focsle Deck থেকে Accommodation এর দিকে হাঁটা শুরু করে দিলাম। কফি তো বানাবো কিন্তু Coffee Bar থেকে এখান অবদি সেটা নিয়ে আসতে আসতে তার যে কি হাল হবে এবং তারপর সেটার জন্য আমি গালাগালি খাবো এটা ভেবে আমার খারাপ লাগছিলো। এর একমাত্র সমাধান ছিল একটা গরম রাখার Flask, কিন্তু আমি কোথায় সেটা পাবো? এতো রাতে GS নিশ্চয় Galley’তে থাকবে না?
এই Resource’এর সমস্যা Seafaring Life’এর একটা অঙ্গ। এখানে কোনো কাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় Material Resource বা Human Resource’এর প্রাপ্যতা অনেকটাই Hierarchy’র ওপর নির্ভরশীল। Rank’এর দিক থেকে Top Level ‘এ না পৌঁছনো অবদি জাহাজের বেশির ভাগ কাজই আপাতদৃষ্টিতে সুসম্পন্ন হবার সম্ভব্য সীমানার বাইরে অবস্থিত বলে মনে হবে। এই সমস্যা হয়তো 90% Seafarer’দের সুদূরপ্রসারী কর্মজীবনে, তাদের job-Satisfaction’এর ওপর যথেষ্ট নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। আবার Top Level’এর ক্ষেত্রেও, প্রয়োজনীয় Shore Support অর্থাৎ Land Segment’এ অবস্থিত Shipping Company বা কোনো Private অথবা Government Agency’র সমর্থন বা সহায়তা অপর্যাপ্ত হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত ভারতীয় কর্মসংস্কৃতিতে, যে কোনো স্তরে, Team -Work ভালো এই কথা বলা বোধহয় বাতুলতা, তাই কাজের ক্ষেত্রে ‘জোগাড়’ এই জিনিসটাই যথার্থ অর্থে, বেশি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
কোনো একটি জাহাজের Anchor Heave করার ভিডিও (Video Credit)
Coffee Bar’এ পৌঁছে দেখি GS নিজের জন্য কফি তৈরী করছে, বুঝলাম যে জাহাজ Port’এ যাচ্ছে বলে ওকে ঘুম থেকে তোলা হয়েছে, কারণ ওই সময় তো ওর থাকার কথা নয়। ওকে Flask’এর কথা বলতে, ও বললো ও জানেনা। যাইহোক আমি একটা Coffee Mug’এ কফি বানিয়ে নিয়ে, Focsle’এর দিকে তাড়াতাড়ি হাঁটা শুরু করে দিলাম। কোনো রকমে C/O হাতে কফিটা দিতে ও সেই প্রায় ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফিটা খেয়ে নিলো। আমাকে বললো Coffee Mug’টা এখনকার মতো ওখানেই কোথাও রাখতে এবং Mooring Station হয়ে গেলে মনে করে রেখে আসতে, যেন ভুল না হয়।
Jetty’র কাছাকাছি জাহাজ আসতে Mooring Operation শুরু হয়ে গেলো, Forward Mooring Station’এর দ্বায়ীত্বে C/O এবং Aft Mooring Station’এ 2/O , ক্যাপ্টেন-সাব আর 3/O Bridge’এ। এছাড়াও Port থেকে Pilot Boat’এ করে একজন Pilot জাহাজে এসেছে, যিনি ক্যাপ্টেন-সাবের বিশেষ উপদেষ্টা হিসাবে তার সাথে Bridge’এ উপস্থিত। পৃথিবীর যে কোনো Port’এ Arrival এবং Departure Mooring Station’এর সময় এবং কিছু ক্ষেত্রে Anchoring বা অন্য কোনো Operation’এর জন্য, জাহাজের ক্যাপ্টেনের উপদেষ্ঠা হিসাবে, Port দ্বারা নিযুক্ত কোনো বিশেষজ্ঞ ব্যাক্তির উপস্থিতি বাধ্যতামূলক, তাকেই Pilot বলা হয়। এছাড়া Port’এর তরফ থেকে তিনখানা Tug Boat’ও আমাদেরকে সাহায্য করছে। Forward Station’এ সে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা, C/O’এর প্রচন্ড চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যে অবশেষে Mooring Operation শেষ হল, ক্যাপ্টেন-সাব ‘Finish With Forward Station’ আদেশ দিতে তবে আমরা Forward Station ছেড়ে যাবার অনুমতি পেলাম। আমি ওখান থেকে Midship অঞ্চলে Manifold’এর কাছে চলে এলাম।
Bosun এর তত্ত্বাবধানে Gangway Rig হতে না হতেই প্রায় এক ডজন লোক জাহাজে উঠে এলো। ওরা সবাই ক্যাপ্টেন-সাব এবং C/O’এর সাথে দেখা করতে Accommodation ভেতর চলে গেলো। ওদের মধ্যে Customs Officer, Health Inspector, Immigration Officer, Port Authority, Cargo Surveyor ইত্যাদিরা অন্যতম। Manifold’এ জাহাজের Cargo Line’এর সাথে Shore’এর Cargo Line’এর Connection’এর কাজ শুরু হয়েছিল, এখানে Pumpman, Port’এর লোকেরা এবং একাধিক Deck Crew কাজ করছিলো। Bosun সবাইকে বললো Manifold’এর Connection’এর কাজ শেষ হলে তবে Deck Crew’দের একটা দল যেন Knock Off করে, কারণ এর পর থেকে ‘Six On Six Off Duty’ চালু হবে। ততক্ষনে রাত্রির অন্ধকার থেকে হালকা দিনের আলো ফুটে উঠেছে, চার দিকে অসম্ভব ব্যাস্ততা, হঠাৎ একজন AB আমাকে বললো,
— মিত্র, তোমাকে C/O Cargo Control Room’এ ডাকছে
কোনো একটি তেলবাহী জাহাজের Arrival Mooring Station’এর ভিডিও (Video Credit)
Accommodation’এর প্রথম Deck’টাতে জাহাজের বিশাল Cargo Control Room (CCR), এর সাথে সংলগ্ন ক্যাপ্টেন-সাব আর C /O’এর অফিস। Cargo Operation এর সময় এই জায়গাটা Bridge’এর ভূমিকা নিয়েছে। এই CCR থেকে Cargo এবং Ballast Line’গুলোর অগুন্তি Electro-Hydraulic Valve খোলা বা বন্ধ করা যায়। মস্তবড়ো Panel’টাতে বিভিন্ন Pipe Line’এর বিস্তারিত Drawing দেওয়া, এছাড়াও Cargo Operation সম্বন্ধীয় একাধিক অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। এখন থেকেই Loading’এর সমস্ত কাজ পরিচালনা করা হবে। জাহাজ যেহেতু Jetty’তে বাঁধা তাই Bridge এখন বন্ধ, আর Deck Department’এর অন্যান্য কাজও এখন এখান থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হবে, যেমন Port’এর বা Jetty’র সাথে communication ইত্যাদি। এই মুহূর্তে এখানে একাধিক Port Official’দের সাথে ক্যাপ্টেন-সাব এবং C/O নানান কাজ নিয়ে ব্যাস্ত। 3/O আমাকে একটা Walkie-Talkie দিয়ে বললো,
— অলোক, এখন থেকে সবসময় এই Radio’টা যেন তোর সাথে থাকে, Cargo Work’এ যারা যারা Duty করবে তাদের কাছে সব সময় Radio থাকা চাই, আর ডাকলেই যেন সাড়া পাওয়া যায়
— Yes Sir
ও আমাকে কি ভাবে রেডিওটা ব্যবহার করতে হয়, সেটা বুঝিয়ে দিলো। ওর নির্দেশ অনুযায়ী আমি এবার Deck’এ ফিরে এসে Pumpman’কে সাহায্য করার কাজ পেলাম। এই মুহূর্তে Pumpman একজন অত্যন্ত ব্যাস্ত লোক, C/O ওকে Radio’তে একাধিক কাজের কথা বলে চলেছে, আর ওই মস্ত বড়ো জাহাজে ও একা ছুটে বেড়াচ্ছে। আশ্চর্যের কথা এই যে মেজাজ গম্ভীর হলেও, এখন আর ও আমাকে নিয়ে বিরক্ত নয়, ও আমাকে নিৰ্দেশ দিয়ে কাজ করাচ্ছিল, আর কোনো গালাগালি বা বকাবকি নয়, এমন নির্দেশ দিচ্ছিল যাতে আমি কাজ গুলো করতে পারি। আমি যে ওর কাজে আসছি, সেটা ভেবে আমার কাজ করার উদ্দম অনেক বেড়ে গেছিলো।
জাহাজের Cargo Tank গুলো Swedish Crew’রা আগে থেকেই Ballast Passage’এর সময় খালি এবং Crude Oil Load করা জন্য উপযুক্ত ভাবে Prepare বা প্রস্তুত করে রেখে ছিল। Port’এর Surveyor’এর সাথে C/O সমেত Pumpman, একজন AB এবং আমি, এই দলটা, প্রত্যেকটা Tank’কের Sounding নিয়ে সেগুলো লিখে রাখছিলাম। এই জাহাজটাতে চব্বিশটা Cargo Tank আছে, এছাড়াও আরো অন্যান রকম Tank আছে, যা নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করবো। এখানে C/O’এর কাজ নষ্ট করা কোনো গালাগালি নেই, Pumpman একের পর এক Tank’এর Sounding নিচ্ছিলো, আমি আর একজন AB ওর নির্দেশ মতো ওকে নানান সাহায্য করছিলাম। C/O বরঞ্চ European Surveyor’এর সাথে একপ্রকার খোশামুদি কথা বলে হাসি ঠাট্টা করছিলো। Pumpman লোকটা এই দুদিনে এতবড়ো জাহাজ আর তার Pipeline Line, Valve ইত্যাদি সম্পর্কে এতো কিছু জেনেছে দেখে আমি আশ্চর্য হলাম। মনে হচ্ছিলো C/O’ও এই কাজ গুলোর জন্য Pumpman এর ওপর যথেষ্ট নির্ভরশীল।
এরপর Loading Operation’এর বিভিন্ন কাজ হতে থাকলো, যেমন Pipeline’এর নানান Valve খোলা বা বন্ধ করা, কোনো বিশেষ Cargo Tank’এ তেল Load করার জন্য Line Set করা, অর্থাৎ সেই Valve গুলোকে খোলা যাতে Crude Oil শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কোনো Tank’এর ভেতরই যেতে পারে। Cargo Tank গুলো Inert Gas, যা একপ্রকার Nitrogen এবং Carbon-Dioxide Gas’এর মিশ্রণ দিয়ে ভর্তি করা থাকে, তার Pressure Monitor বা পরিবীক্ষণ করা ইত্যাদি বিভিন্ন কাজ যা Loading Operation‘এর অন্তর্ভুক্ত।
জাহাজ যখন তেল Load করে তখন Port’এর Pump ব্যবহার করা হয়, আবার Discharge Port’এ গিয়ে যখন সেই তেল Discharge করা হয়, তখন জাহাজ তার নিজস্ব Pump ব্যবহার করে। জাহাজের এই বড়ো বড়ো Pump গুলো যেখানে থাকে, সেই জায়গাকে Pump Room বলে। এই জাহাজের Pump Room, যেখানে পাঁচটা Pump রাখা আছে, Main Deck থেকে তা প্রায় 9 তলা গভীর, অর্থাৎ একদম Bottom Level ‘এ Pump’গুলো রাখা আছে। জাহাজের দৈর্ঘ বরাবর এই সবথেকে নিচের স্তরকে Keel বলা হয়। Loading Operation’এর ক্ষেত্রে জাহাজের Pump ব্যবহৃত না হলেও Line Set করার জন্য আমাদের একাধিক বার Pump Room’এর একেবারে নিচে অবধি যেতে হচ্ছিলো।
কিছুক্ষনের মধ্যে Loading শুরু হয় গেল এবং আমি Pumpman’এর সাথে বিভিন্ন কাজ করতে লাগলাম। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো হলো,
Setting up the manifold
Opening, closing of cargo line valves and setting line for different tanks
Inspecting cargo pipelines and valves
Checking tank liquid levels (Ullage) by Whessoe Gauge
Inert Gas Pressure and Deck Seal checkings
Monitoring pipeline pressure
Checking for Cargo leaks
Safety checks
ইত্যাদি ইত্যাদি
তখন 12:00 বেজে গেছে, Pumpman সবে C/O’এর থেকে অনুমতি নিয়ে Lunch করতে গেছে। C/O আমাকে Radio ‘তে বললো,
— Cadet , তুমি কোথায়
— আমি Manifold ‘এর কাছে Sir
— No 4 Center Tank’এর ullage দেখে আমাকে বলো
— OK Sir
— OK’টা আবার কি? কি ভাবে কথা বলতে হয় জানোনা? Rascal, OK শব্দটা যদি আরেকবার তোমার মুখে শুনি মজা দেখিয়ে দেব। বলো Yes Sir, এখন যাও, যেটা বললাম করো
প্রথম কথা হলো কিছুক্ষন আগে আমি Pumpman’এর কাছে Ullage দেখতে শিখেছি, কিন্তু আমি No. 4 Center Tank ‘এর Whessoe Gauge কোথায় সেটা ঠিক জানি না। এই অঞ্চলে কোনো Deck Crew’কেও দেখতে পেলাম না যে জিজ্ঞাস করবো। ওদিকে C/O আমার নাম করে অনবরত রেডিওতে চেঁচিয়ে চলেছে।
কোনো একটি জাহাজের CCR বা Cargo Control Room’এর ভিডিও (Video Credit)
— Cadet, Where the fu*k are you?
এই অবস্থায় আমার উত্তর দেবার কিছু নেই। এইভাবে মিনিট পাঁচেক চেঁচামেচির পর, রেডিওতে Pumpman’এর গলা শুনলাম,
— Chief সাব, আমি Deck’এ এসে গেছি, আমি Ullage দেখে আপনাকে বলছি
— Pumpman ওই Idiot’টাকে Cargo Control Room’এ পাঠাও
আমাকে দেখতে পেয়ে Pumpman হাতের ইশারায় Cargo Control Room’এ যেতে বললো।
ওখানে গিয়ে আমি আরো গালাগালি খেলাম। এবারে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে আমি কেন Radio’তে ডাকার পরও কোনো উত্তর দিইনি। আমি কাজটা করতে পারি বা না পারি, সেটা পরের কথা, আমাকে Radio’তে যখন ডাকা হয়েছে আমি তার উত্তর দিতে বাধ্য। ওদিকে আমি রাত্রি এক’টার সময় ঘুম থেকে উঠেছি আর এখন প্রায় দুপুর সাড়ে-বারো’টা বাজে। এর মধ্যে আমি আট’টার সময় একবার আধ-ঘন্টার জন্য Breakfast করার আর দশ’টা নাগাদ পনেরো মিনিট চা খাবার সুযোগ পেয়েছি । 3/O আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
— অলোক, তুই Lunch করেছিস?
— No Sir
3/O , C/O কে বললো, ,
— Sir, ওকে Lunch করতে পাঠাই?
— ঠিক আছে যেতে বলো। পনেরো মিনিটের মধ্যে Lunch করে চলে এসো, Go
এসব কিছুর মনের ওপর গুরুতর বিরূপ প্রতিক্রিয়া আছে। জাহাজ আর পাঁচটা জায়গার মতো নয়, এটা একটা বিপদজনক জায়গা। এখানে Main Deck‘এ প্রায় শতখানেক এমন গর্ত আছে, যাকে Butterworth Hatch বলা হয় এবং বিভিন্ন প্রয়োজনে কিছু কিছু Butterworth Hatch Cover খুলতে বা খুলে রাখতে হয়। ভুলক্রমে তাতে পা পড়লে, সেগুলোর মধ্যে দিয়ে একটা মানুষ প্রায় নয়-তলা Tank‘এর একদম নিচে গিয়ে পড়বে। Loading’এর সময় জায়গায় জায়গায় বিষাক্ত Inert Gas অথবা Hydrocarbon Gas বেরোতে থাকে এবং নিঃশাসের সাথে এই Gas বেশি পরিমান দেহের মধ্যে গেলে চূড়ান্ত রকম ব্রেনের ক্ষতি, এমনকি মৃত্যু হতে পারে। এইখানে যদিও একজন শিক্ষানবিসকে কেউ এমন কাজ একা করতে দেয়না, যেখানে অন্যদের বা সারা জাহাজের ক্ষতি হতে পারে, কিন্তু সে নিজের ভুলের জন্য সহজেই ঘায়েল হতে বা মরতে পারে, Shipping Industry’তে এইরকম ঘটনার নজিরের অভাব নেই। এইরকম জায়গায় ভয় দেখিয়ে কাজ করানো বা ক্রমাগত মানসিক যন্ত্রনায় কাউকে রাখার ফলাফল অত্যান্ত বিপদজনক হতে পারে। আমি জানি যে Cadet হিসাবে মানসন্মান কোনো ব্যাপার নয়, কিন্তু এতো ‘লাথখোর’এর জীবন, যুক্তি দিয়ে একে নেমে নেওয়া খুবই শক্ত। আমি এটা বুঝেছিলাম যে মানসিক ভাবে এই যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
Lunch এর পর, Deck’এ এসে AB’দের কাছে জানলাম যে এই ‘Six On Six Off Duty ‘তে দুটো দল, 3/O এর অধীনে (06:00 – 12:00) & (18:00 – 24:00) এবং 2/O’এর অধীনে (12:00 – 18:00) & (00:00 – 06:00), Rotation’এ প্রত্যেকে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে একেকটা দল বারো ঘন্টা করে কাজ করবে। C/O যেহেতু Cargo Operation’এর সামগ্রিক ভাবে In-charge তাই ওর কোনো বিশেষ Duty Hours নেই, বরঞ্চ ও যেকোনো সময়ই Available বলা যেতে পারে, ঠিক যে রকম ক্যাপ্টেন-সাব Sailing’এর সময় থাকেন। যদিও এক্ষেত্রে যথারীতি ক্যাপ্টেন-সাবই সর্বেসর্বা। আর আমার Duty‘র ব্যাপারে কিছু ঠিক নেই, ওরা C/O‘কে জিজ্ঞেস করতে বললো। Pumpman বললো ওর Duty‘রও কোনো সঠিক সময় নেই, C/O’এর প্রয়োজন মতো ওকে Duty করতে হবে। Loading’এর এই তিনদিন ওকে সবসময় C/O এর সাথে থাকতে হবে। এছাড়াও যখনই কোনো গুরুন্তপূর্ণ কাজ হবে যেমন, নতুন কোনো Tank’এ Loading শুরু করার জন্য Line Set করা হবে বা অন্য কোনো প্রয়োজন হলে ওকে আসতে হবে। আবার Loading শেষের সময় যখন Topping Up’এর কাজ হবে, তখন বহুক্ষণ একনাগাড়ে কাজ করতে হবে। প্রথমে সমস্ত Tank গুলোতে মোটামুটি 85-90% অবধি Bulk Loading করে, তারপর একে একে সমস্ত Tank’এ শেষ পর্যায় তেল ভর্তি করার প্রক্রিয়াকে Topping Up বলে।
কিছুক্ষন বাদে 2/O আমাকে Cargo Control Room (CCR) ‘এ ডেকে বললো,
–অলোক, C/O বিশ্রাম নিতে গেছে, বলছে তুই Pumpman’এর সাথে Duty করবি। Pumpman এখন knock off করছে, তুইও ছুটি কর, আর সন্ধে ছ’টার (18:00 ) সময় Duty‘তে আয়। Walkie-Talkie‘টা Charge’এ রেখে যা, Radio যেন Charger’এর বাইরে এমনি পড়ে না থাকে
— Yes Sir, Thank You Sir
আমি যথারীতি অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলাম এবং কাবিনে গিয়ে চান করে ঘুমিয়ে পড়লাম।
এরমধ্যে আমাকে কেউ ফোন করেনি। আমি তৈরী হয়ে পৌনে ছ’টার সময় CCR’এ গিয়ে দেখি 2/O আর 3/O দুজনেই বসে আছে, C/O তখন আসেনি। যাইহোক কিছুক্ষনের মধ্যে Pumpman, C/O দু’জনেই এসে গেলো, 18:00’টা থেকে 3/O, Cargo Watch Take-Over করার পর আমি আর Pumpman নতুন Line Set করার জন্য Deck’এ চলে এলাম। Sailing বা Port দুই ক্ষেত্রেই দেখা যাবে যে 2/O’এর Watch’এ সাধারণত Action অপেক্ষাকৃত কম। এর কারণ এই যে সেই সময় ক্যাপ্টেন এবং C/O বিশ্রাম করবে। 2/O একা তার Watch পরিচালনা করতে 3/O‘এর চাইতে স্বাভাবিক কারণেই বেশি সক্ষম এবং কোন সমস্যা কোথায় গিয়ে কতটা ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াতে পারে, সে বিষয় তার অভিজ্ঞতা এবং পারদর্শিতা বেশি। সে যথাসম্ভব তার Bridge Watch এবং Cargo Watch উভয় ক্ষেত্রেই সবাইকে বিশ্রাম নেবার সুযোগ দেবে, যাতে উপযুক্ত সময় পরিকল্পিত কাজগুলো সুসম্পন্ন করা যেতে পারে। তাই কোনো 3/O যতক্ষণ না যথেষ্ট দক্ষ হয়ে ওঠে, তাকে 2/O’এর পদ বা Rank’এর জন্য Promotion দেওয়া হয় না।
Pumpman’এর সাথে থেকে বিভিন্ন কাজ করা ছাড়াও, C/O আমাকে একা, ক্রমাগত অন্য কাজ দিচ্ছিলো, যেমন বিভিন্ন Line’এর Cargo Loading Pressure Check করা, কোনো বিশেষ Valve বন্ধ বা খোলা, Whessoe Gauge দেখে বিভিন্ন Tank’এর Ullage বলা, Deck Scupper Plug খোলা বা বন্ধ করা ইত্যাদি। এর অনেক কিছুই আমি না করতে পারার বা ভুল করার জন্য, আমি এক প্রকার এই কাজের অযোগ্য প্রমাণিত হয়ে গেলাম। এই ভাবেই বেশ কয়েকটা Cargo Watch পার হয়ে গেলো এবং Loading’এর শেষ পর্যায় Cargo Tank গুলোর Topping Up Operation শুরু হলো। তৃতীয় দিন সকাল থেকে Topping Up শুরু হলো। Loading’এর দ্বিতীয় দিন থেকেই কেমন যেন চিৎকার চেঁচামেচি আরো বেড়ে গেছিলো। আমি যে একা এর শিকার হলাম তা নয়, Pumpman, Deck Crew, এমনকি 3/O’ও বাদ পড়লোনা। C/O এবং Pumpman’এর মধ্যেও একাধিক সমস্যা শুরু হয়ে গেলো, বেচারা Pumpman C/O’এর কাছে গালাগালি খাচ্ছিলো। এখানে কে ঠিক বা কে ভুল বোঝার ক্ষমতা আমার নেই, কিন্তু গালাগালি খেয়ে আর শুনে, এখানকার কর্মসংকৃতির ওপর আমার বিতৃষ্ণা ধরে গেছিলো। এটা যে একটা দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের জায়গা সে বিষয় আমার কোনো সন্দেহ নেই। Loading শেষ হওয়া অবদি যদিও Oil Spill বা Tank Overflow ইত্যাদি প্রকারের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি, তবুও কেমন যেন চেঁচামেচি শুনে মনে হয়েছিল যে এদের Team Work অত্যন্ত দুর্বল, C/O অনেক ক্ষেত্রেই অবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছিল আর ভগবানই তাকে বাঁচিয়েছে। বিকেলের দিকে Loading শেষ হলো, সমস্ত জাহাজের সে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। এদিকে Loading শেষ হবার সাথে সাথেই তাড়াহুড়ো করে জাহাজকে Port থেকে বেরিয়ে যেতে হলো, কারণ Jetty’র ওই Berth’এ আসার জন্য পরবর্তী জাহাজ নাকি একদিন আগে থেকেই Anchor করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আর Pumpman সকাল 0600 থেকে এক নাগাড়ে কাজ করে যাচ্ছি। Loading শেষ হতে আমি Departure Station শেষ করে Bosun’এর দলের সাথে নানান জিনিস Secure করার কাজ করছিলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই জাহাজ Port’এর এক্তিয়ারের বাইরে Open Sea’তে পৌঁছে যাবে, তাই Deck’কে তার জন্য বিশেষ Checklist অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট ভাবে প্রস্তুত করে রাখতে হবে। পোর্ট থেকে বেরোনোর সময় ডেক এবং ডেকে অবস্থিত Store’গুলোর জিনিসপত্র সঠিক জায়গায় এবং কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে, সঠিক ভাবে বেঁধে রাখা অত্যন্ত জরুরি। কারণ পরে আবহাওয়া বেশি খারাপ হয়ে গেলে, আর ডেকে আসা সম্ভব হবে না, বিশেষত Loaded জাহাজে। সে ক্ষেত্রে জিনিস তো নষ্ট হবেই, উপরোন্ত সমুদ্রের ঢেউতে জাহাজ অনবরত দোলার কারণে অনেক কিছু তছনছ হয়ে সাংঘাতিক বড়ো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই সবকিছু উপযুক্ত ভাবে Secure করা অত্যন্ত জরুরি। Loaded অবস্থায় জাহাজের চেহারা খালি অবস্থার তুলনায় বড়োই অন্য রকম, সেই প্রকান্ড উঁচু বিশাল জাহাজটা আর নেই, এখন Deck’এর কাছেই সমুদ্রের জল, যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। তার কারণ জাহাজটা প্রায় 76 ফুট জলের মধ্যে ডুবে আছে, অর্থাৎ আমাদের জাহাজের Draft এখন প্রায় 23 মিটার।
17:00 ‘টার সময় Bosun’এর থেকে ছুটি নিয়ে কেবিনে গিয়ে চান করে বিশ্রাম করছিলাম, যদিও এই সময়টাতে অর্থাৎ16:00 থেকে 20:00 অবধি আমার C/O এর সাথে Bridge Watch করার কথা, কিন্তু ওই সময় আমাকে কি Duty করতে হবে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। Bridge’এ ফোন করা বা Bridge’এ গিয়ে কথা বলতে Bosun’কেও ইতস্তত করতে দেখি, আমি তো কোন ছাড়। Bosun’এর কাছ থেকে এটাও জেনেছিলাম যে Bridge’এ 3/O Duty‘তে আছে। হঠাৎ ছটা নাগাদ কেবিনের ফোন বাজতে লাগলো, রিসিভের ওঠাতে ওদিক থেকে AB’র গলা পেলাম,
— Cadet, তোমাকে C/O Bridge’এ ডাকছে। এখুনি Bridge’এ এসো
ওর গলার আওয়াজ শুনেই বুঝতে পারলাম যে কোনো গন্ডগোল পাকিয়েছে। নিজের এই ভয় পাওয়া মনটার ওপর আমার ঘেন্না ধরে গেছিলো। কিন্তু কিছুতেই এই বিরক্তিকর অনুভূতি থেকে মুক্তি পাচ্ছিলাম না।
একটি Fully Loaded ULCC বা Ultra Large Crude Carrier জাহাজ (Photo Credit)
এখন রাত্রি ন’টা বাজে, অন্ধকারে যেন আমি গভীর সমুদ্রের মধ্যেখানে দাঁড়িয়ে আছি। ভাবছি এ কোথায় এসে পড়লাম, জীবনের সমস্ত স্বপ্ন ভেঙেচুরে চুরমার। ততক্ষনে আমি মন ঠিক করে ফেলেছি যে, যা হয় হবে, এই Career আমার চাই না, সেই কৈশোরের সময় থেকে এতগুলো বছর ধরে, কিছু না জেনে বুঝে যে স্বপ্ন দেখেছি, সব ভুল। আমি সাত সমুদ্র তেরো নদী আর পেরোতে চাই না। এই Toxic Work Culture আমার আর সহ্য হচ্ছেনা। নিশ্ছিদ্র অন্ধোকারের মধ্যে দূরে দূরে বিচ্ছিন্ন কয়েকটা আলো, ওগুলো অন্য জাহাজের আলো, কারণ এই জায়গার একশো কিলোমিটারের মধ্যে কোনো দেশ বা দ্বীপ নেই। আমি Bridge’এর বাইরে, Starboard Side Bridge Wing’এ দাঁড়িয়ে। এটা একটা Punishment, C/O’কে Report না করে Knock-off করার জন্য এই শাস্তি। টানা তিন ঘন্টা আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি।
গত সাত দিন ধরে আমি শুধু গালাগালি খাচ্ছিলাম, এবারে সরাসরি শাস্তি দেওয়া শুরু হয়েছে। আজকে শাস্তিস্বরূপ আমাকে Dinner Table’এ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবার খেতে হয়েছে, বসে খাবার খাওয়ার অনুমতি নেই। আমার যদি Total Sea-Time বা জাহাজে কাজ করার অভিজ্ঞতা মাত্র সাত দিনের হয়ে, তবে জাহাজের কাজ বা রীতিনীতি আমি কোথা থেকে শিখবো? এখানে আসার আগে আমি Mumbai’তে যে তিন মাসের Pre-Sea Training করেছি সেটা একটা সামান্য Introduction মাত্র, একথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই যে এখানে কাজ করার জন্য যে Expertise বা দক্ষতার প্রয়োজন, তা অর্জন করতে বহু বছর লাগে। আমার থেকে সেটা কেন আশা করা হচ্ছে সেটাই আশ্চর্যের কথা। আর তার জন্য এতো বকাবকি, অপমান, দুর্ব্যবহার। Senior’দের Junior’দের প্রতি এই ব্যবহার অনেক প্রফেশানেরই একটা অঙ্গ, জাহাজের ক্ষেত্রেও তাই, স্কুল কলেজের ক্ষেত্রে Ragging কথাটা বেশ পরিচিত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর পরিণতি দুর্ঘটনা, এমনকি মৃত্যুও।
এখানে আমার অবস্থা একজন যুদ্ধবন্দির মতো , আমার ওপর মানসিক অত্যাচারের কোনো শেষ নেই, এইভাবে চলতে থাকলে আমার Nervous Breakdown হয়ে যাবে। যদিও আমি জানতাম যে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে না, আর আমি আত্মহত্যাও করবো না, কারণ আমার হাতে এর থেকে বাঁচার একটা শেষ অস্ত্র আছে, চাকরি থেকে Resign করা।
এখন Discharge Port নিয়ে অনেক কানাঘুষো শুনেছি, Crew’রা কেউই জানেনা জাহাজ কোথায় যাচ্ছে। Officer’রা জানে, কিন্তু তারা বলবে না, বলার নাকি অনুমতি নেই। Galley News হচ্ছে যে আমরা Europe যাচ্ছি।
জাহাজে কোনো গুজবের খবর কে Galley News বলা হয়। যেখানে খাবার তৈরী করা হয়, জাহাজের সেই রান্নার জায়গাকে Galley বলে। জানা যায় যে, বহু বছর আগে যখন জাহাজে ইঞ্জিন ব্যবহার হতো না, অর্থাৎ পাল তোলা আর দাঁড় দিয়ে টানা জাহাজের সময়, একমাত্র Captain’ই শুধু জানতো জাহাজ কোথায় যাবে, সেই আগামী Port এর ETA’র (Estimated Time of Arrival) অর্থাৎ পৌঁছনোর আনুমানিক সময়ের ভিত্তিতে, তিনি Chief Cook কে আদেশ দিতেন খাবার এবং বিশেষত পানীয় জল, মজুত রাখার জন্য। অর্থাৎ Chief Cook জানতে পারতো যে মোটামুটি কত দিনের Voyage’এর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সেই খবরের ওপর ভরসা করে পরবর্তী Port নিয়ে বিভিন্ন গুজব তৈরী হতো। Galley থেকেই এই গুজবের সূত্রপাত হতো বলে, জাহাজের যে কোনো গুজবকে আজও Galley News বলা হয়।
এই অত্যাধুনিক জাহাজটাতে অবশ্য তিন থেকে চার মাসের খাবার সংরক্ষণের সুব্যাবস্থা আছে, Distillation Plant’এর সাহায্যে সমুদ্রের নোনা জল থেকে পর্যাপ্ত পরিমানে Fresh Water তৈরী করা হয়। কিন্তু আমার কাছে সে সব প্রলোভনের দিন শেষ, Europe, America, Japan যেখানেই যাক, আমি শুধু একটা জিনিস জানি যে মোটামুটি আরো এক দিন বাদে আমরা Fujairah পৌঁছবো আর সেখানে Sweden দেশের নাগরিক, পুরোনো Chief Officer, তিনি নেবে যাবেন, অর্থাৎ জাহাজ সেখানে কিছুক্ষন থামবে, আর সেইটাই আমার শেষ সুযোগ। এই যন্ত্রণাদায়ক অনিশ্চিত জীবনের আমার কোনো প্রয়োজন নেই। এখানে সবাই যে আমার সাথে সবসময় দুর্ব্যবহার করছে তা নয়, কিন্তু আমার প্রতি যে কারোর কোনো সহানুভূতি নেই, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। গত কয়েক দিন Deck’এ কাজ করার সময় এই Swedish C/O আমাকে অনবরত Radio’তে গালাগালি খেতে শুনেছে, কারণ একটাই Channel’এ সবাইকার Radio Set করা আছে। অর্থাৎ কে কাকে Radio’তে কি বলছে তা সবাই শুনতে পারছে, এই প্রকার Communication System’কে Two Way Radio বলে, এখানে যেকোনো সময় কেবল মাত্র একজনই কথা বলতে পারে। তবু আশ্চর্য ভাবে একমাত্র উনি আমাকে Deck’এ কয়েকবার Hello বলে অভিবাদন করেছেন, বাস্তবিক ভাবেই এতে আমি আশ্চর্য হয়েছি । যেহেতু ওনাকে একজন Expert হিসাবে এই জাহাজে রাখা হয়েছে তাই উনি এখানে অত্যন্ত সম্মানীয় মানুষ, তাই আমার মতো একজন নগন্য মানুষকে নিজে থেকে Hello বললে আমার আশ্চর্য হওয়াটাই স্বাভাবিক।
সামনের অন্ধকার সমুদ্রের দিক থেকে চোখ সরিয়ে Bridge’এর দিকে তাকিয়ে দেখলাম। অন্ধকারে দেখা না গেলেও আমি জানি যে 3rd Officer তার Navigational Watch Keeping Duty তে ব্যাস্ত। এই সময়টাতে সে Independent Navigating Officer, তাকে সাহায্য করার জন্য তার আধীনে একজন AB বা Able-Bodied Seaman ডিউটিতে আছে। সমুদ্রের অন্য কোনো জাহাজ বা ভাসমান অন্য কিছু অথবা অন্য কোনো কারণে যদি আমাদের Course, অর্থাৎ কম্পাসের 0 থেকে 360 Degree’র মধ্যে যে পরিকল্পিত Direction এ জাহাজ চলছে, তার পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয়, 3rd Officer তৎক্ষনাৎ তা করবে। সে ব্যাপারে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে তার যদি কোনো সন্দেহ হয়, তাহলে টেলিফোনের মাধ্যমে সে Captain এর সাথে যোগাযোগ করবে এবং Captain ও তাকে সে ব্যাপারে উপদেশ দিতে বা সমস্ত রকম সাহায্য করতে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে দ্বায়বদ্দ।
আমি আমার অশান্ত মনের গভীরের কাছ থেকে সেই শেষ সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিলাম, যাতে ওদের এই কর্মযজ্ঞের মধ্যে গিয়ে, Bridge এর ভেতর ঢুকে আমি বলতে পারি যে আমি অফিসার হতে চাই না, Captain হতে চাই না, আমি Resign করতে চাই, আমি Captain Sir কে এই কথা জানাতে চাই, যাতে কাল Fujairah থেকে আমি Sign-Off করতে পারি। হঠাৎ আমার মনে হলো, আমার তাই করা উচিত।
অন্ধকার Bridge’টার ভিতর গিয়ে 3/O’এর সামনে দাঁড়াতে ও নিজে থেকেই বললো,
— Chief -সাব আমাকে ফোন করেছিল, তোমাকে স্যার সাড়েন’টার সময়ে Knock -Off করতে বলেছে। তুমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াও, সাড়েন’টা বাজলে আমি তোমাকে বলে দেব
— Sir, আমি চাকরি থেকে Resign করতে চাই, আমি Captain-সাবের সাথে কথা বলতে চাই
কথাটা বলতে পেরে আমার মনের সব ভয় এবং দুঃখ মুহূর্তের মধ্যে যেন কোথায় হারিয়ে গেলো। আমি যেন নিজের বলা কথার আদেশ মানতে বাধ্য হয়ে পড়লাম। এখন কোথায় 3/O কোথায় C/O, আমি সজ্ঞানে জাহাজের Captain‘কে ডেকে পাঠাচ্ছি, আমার সাথে কথা বলার জন্য। আমার কোনো ভয় নেই, কারণ এদের থেকে আমি আর কিছু চাই না। একমাত্র মৃত্যু ভয় ছাড়া এই মুহূর্তে আমাকে অন্য কোনো ভয় গ্রাস করতে পারবেনা। 3/O বোধহয় আমার কথার দৃঢ়তা অনুভব করেছিল, খুব আস্তে করে ও একবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
— Are you Sure?
— Yes Sir
হঠাৎ সবাই যেন আমার কথা শুনতে শুরু করেছে, Captain-সাবকে ফোন করতেই উনি Bridge’এ চলে এলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
— Yes Cadet , কি ব্যাপার, তুমি নাকি Resign করতে চাইছো ?
— Yes Sir , কালকে Fujairah থেকে আমি India ফিরে যেতে চাই, আমি কি আপনাকে একটা Resignation Letter লিখে দিতে পারি?
— সেটা তুমি কালকে দিলেও চলবে? কিন্তু কেন তুমি Resign করতে চাও?
— Sir, C/O আমার সাথে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করছে, তাছাড়া এই কদিন কাজ করে আমি বুঝেছি যে Merchant Navy’র Career আমার জন্য উপযুক্ত নয়
— মাত্র সাত দিনে তুমি কি করে বুঝলে যে এই Career তোমার উপযুক্ত নয়? C/O ছাড়া, এখানে তোমার আর কি সমস্যা?
আমি চুপ করে রইলাম। উনি বললেন,
— ঠিক আছে, তুমি একজন Graduate ছেলে, তুমি কোনো বাচ্চা ছেলে নও, আমি তোমাকে জাহাজে কাজ করার জন্য জোর করবে না। তুমি এখন C/O’এর কাছে যাও, আর ওনাকে বলো যে তুমি Resign করছো
C/O’এর কাছে যেতে আমার কোনোই ইচ্ছে ছিল না। আমি বললাম,
— আমি C/O সাথে দেখা করতে চাইনা। ও আমাকে গালাগালি করবে, আমার ওকে কিছু বলার নেই। আমি আপনাকে অনুরোধ করছি যে আপনি দয়া করে কালকে আমাকে India’তে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিন
— C/O যদি তোমার সাথে দুর্ব্যবহার করেন তো তুমি এখানে ফিরে এসো। আমি Bridge’এ তোমার জন্য অপেক্ষা করছি । তুমি গিয়ে বলো যে আমি তোমাকে ওনার কাছে পাঠিয়েছি
এর ওপর কিছু বলার নেই। আমি ‘Yes Sir ‘ বলে Bridge’এর দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলাম। এখন আমার চলাফেরা বদলে গেছিলো, কে কি ভাববে বা কি বলবে, সে সব আমার মাথায় আসছিলো না। আমার মনে কোনো ভয় নেই, আমি যে চাকরিটা ছেড়ে দিতে পেরেছি সেটা ভেবে আমার ভালো লাগছিলো। উনি একবার জিজ্ঞেস করলেন,
— C/O’এর কেবিন কোথায় তুমি জানো ?
— Yes Sir
কেবিনে গিয়ে বেশ কিছুক্ষন ধরে দরজায় টোকা দিতে C/O দরজা খুলে ওই অসময় আমাকে দেখে গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করলো,
— কি ব্যাপার, তুমি এখানে কেন?
— Sir, ক্যাপ্টেন-সাব আমাকে আপনার সাথে দেখা করতে বললেন, আমি চাকরি থেকে Resign করেছি, কাল Fujairah থেকে আমি India ফিরে যাবো
— ভেতরে এসো
এই প্রথম আমি C/O এর কেবিনের ভেতরে গেলাম। অসম্ভব সুন্দর কেবিনের ভেতরটা। বিলাসবহুল Day-Room’টাতে সুন্দর বসার ব্যবস্থা। আমি তখনও দাঁড়িয়ে, ও Fridge থেকে আমার আর নিজের জন্য দুটো দামি German Beer হাতে নিয়ে, আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
— কি খাবে? Beer না Whisky?
ছাত্র জীবনে আমি একাধিকবার Alcohol খেয়েছি, ওটা আমার কাছে এমন কিছু ব্যাপার নয়। যদিও এই মুহূর্তে আমি খেতে চাইনা, এই কথাই বললাম। ও বললো,
— আরে খাও খাও। এই Heineken Beer আমার সব থেকে প্রিয় ব্র্যান্ড, আমি নিশ্চিত যে তুমি ভারতে কখনো এতো সুন্দর Beer খাওনি
বাস্তবিকই সেই সময় বিদেশী ড্রিঙ্কস ভারতের মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্নের অতীত ছিল। Shelves থেকে সুন্দর দুটো গ্লাস নিয়ে এসে, আমাকে এক গ্লাস Beer দিয়ে ও বসতে বললো। নিজেও বসলো। সেই Resign কথাটা বলার পর থেকে আমার চারপাশের দুনিয়া বদলে গেছিলো। Beer’টাতে একটা চুমুক দিয়ে, বাস্তবিকই আমার খুব ভালো লাগলো। অনেক্ষন জল খাইনি, যথেষ্ট তেষ্টাও পেয়েছিলো। C/O বলে চললো,
— মিত্র, আমি কোনো খারাপ লোক নোই। আর তুমি আর আমি ভারতের দুটো ভিন্ন রাজ্যের লোক বলে, ভেবোনা আমি চাইনা, যে তুমিও একদিন Chief Officer বানো বা Captain বানো। এটা International Water, এখানে আমরা ভারতীয়, আর এটাই আমাদের পরিচয়। আমি তোমাকে একজন Indian Seafarer বলে মনে করি। তুমি already একজন Seafarer, তুমি আমাদের লোক, তুমি জানো না কিন্তু আমরা জানি। আমরা চাই যে তোমরা এই বয়স থেকে ইস্পাতের মতো কঠিন মানুষ তৈরী হও। Sea-life কোনো সাধারণ life নয়, It is a tough life। একবার তুমি Cadetship শেষ করে Officer বানো, দেখবে ব্যাক্তিগত জীবনের সমস্যা গুলো তোমার কাছে তুচ্ছ বলে মনে হবে। God forbid, যদি কোনোদিন সারা পৃথিবী তোমার বিরুদ্ধে যায়, তুমি সেই দিন এই Cadetship’এর দিনগুলোর কথা মনে করো, দেখবে তুমি বাঁচার ক্ষমতা পাবে। তুমি জানোনা যে আমরা কি প্রচন্ড চাপের মধ্যে কাজ করি। আমার একটা ভুলের জন্য একটা সাংঘাতিক accident হয়ে যেতে পারে, জাহাজে একটা blast হয়ে যেতে পারে, অসংখ লোকের মৃত্যু হতে পারে। Mooring Station’এর সময় দেখেছো তো, আমার একটা ভুল order’এর জন্য এক বা একাধিক লোক মারা যেতে পারে। তুমি যখন Chief Officer হবে আমার এই কথা গুলো মনে করো, তখন তুমি বুঝতে পারবে, এখন নয়। কে কি বললো, কে গালাগালি করলো, এসব চিন্তা করোনা। আর সারা জীবনের জন্য একটা কথা মনে রেখো, Never take anything seriously onboard ship, except safety and health। আমার খারাপ লাগছে যে তুমি আমার জন্য Resign করতে চাইছো , ঠিক আছে আমি হয়তো তোমাকে আর কিছু বললাম না, কিন্তু আমি Sign-Off করে চলে গেলে আরেক জন C/O এসে যদি তোমার সাথে misbehave করে, তখন তুমি কি করবে? যেদিন তুমি তোমার কাজ শিখে যাবে, দেখবে লোকে তোমার ওপর নির্ভর করবে, কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। আরো বলছি ক্যাপ্টেন-সাব ছাড়া, এই জাহাজে আর কেউ যদি তোমার সাথে misbehave করে তো তুমি আমাকে এসে বোলো, I will fu*k his happiness।
ও উঠে গিয়ে নিজের জন্য আর আমার জন্য আরো দুটো Beer নিয়ে এলো। যেহেতু আমার সবথেকে বড়ো সমস্যা C/O কে নিয়েই ছিল , আর এই মুহূর্তে ও আমার সাথে যে আন্তরিকতার সাথে কথা বলছিলো, তাতে আমার মানসিক অবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেছিলো। আমার মনে হচ্ছিলো এক্ষুনি ও যদি আমাকে আবার গালাগালি করে তো আমার আগের মতো হয়তো অতো খারাপ লাগবে না। আমার যে মন বদলে গেছিলো, সেটা বুঝে ও আমাকে বললো,
— আরে মিত্র, কি বাড়ী যাবে, আমরা America যাচ্ছি, আমি তোমাকে বলেছি সেটা কাউকে বোলোনা যেন। এবার দেখো না, Loaded Passage’এ আমাদের কাজের চাপ অনেক কম থাকবে, আমরা কয়েক দিনের মধ্যে Swimming Pool’টাকে ready করে নেবো, Bosun কে আমি বলে দিয়েছি, তোমরাই করবে। জাহাজে Gym আছে, Table Tennis Board আছে, Hobby Room আছে, তুমি জানো? (Swimming Pool ছাড়া বাকি গুলোর কথা আমি জানতাম না)। ঠিক আছে তোমাকে কিছু বলতে হবে না, আমি ক্যাপ্টেন-সাবকে ফোন করে বলে দিচ্ছি যে তুমি Resign করছো না। আরে কমসেকম USA তো চলো, তারপর ওখান থেকে decide করবে বাড়ি যাবে না জাহাজে কাজ করবে। America’টা তো ঘুরে নাও, কি Dubai থেকে বাড়ি ফিরবে, America থেকে বাড়ি ফিরলে দেখবে India’তে তোমার দর বেড়ে যাবে। কি বোলো?
আমি হ্যাঁ বলতে, ও ফোন করে ক্যাপ্টেনসাবের সাথে কথা বলে আমাকে বললো,
— OK, এখন কেবিনে গিয়ে বিশ্রাম করো। কাল সকাল চারটের সময় আমাদের দুজনকেই Bridge Watch করতে হবে। আমি অত্যন্ত ক্লান্ত। আমি হ্যাঁ বলার পর, ওর যে আন্তরিকতা কমে গেলো এমন নয়। ও একই ভাবে কথা বলছিলো। আমাকে Beer’টা শেষ করারও সময় দিলো। আমি ‘Goodnight Sir’ বলে কেবিনে ফিরে এলাম। সেদিনই প্রথম রাত্রি সাড়ে’দশটা থেকে ভোর সাড়ে’তিনটে অবধি দুঃখ আর দুশ্চিন্তা শূন্য মন নিয়ে জাহাজে ঘুমোলাম।
আমার ভালোর জন্যই আমার সাথে এরকম ব্যবহার করা হচ্ছিলো বা এরা কেউই চায় না যে আমি এই চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাই, এই কথা কিছুটা সত্য হলেও, বেশিটাই অসত্য। এর পেছনে আরো জটিল কারণ ছিল।
ক্রমশঃ
[…] March 11, 2025 মার্চেন্ট নেভির জীবন। পর্ব 5 শীঘ্রই প্রকাশিত হচ্ছে….. বাংলা ব্লগ – সাতসমুদ্র মার্চেন্ট নেভির জীবন। পর্ব 4 March 11, 2025 Jetty’তে বাঁধা অবস্থায় কোনো একটি তেলবাহী জাহাজ (Photo Credit)… Read More […]