satsamudra.com

Logo

সাতসমুদ্রdotকম

মালদ্বীপ, দ্যা এটলস

পাহাড়ের কোলে ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি, ভাবতেই বাঙালির মন চলে যায় দার্জিলিঙের পাহাড়ে। দোতলা বা তিনতলা একটা সেকেলে বাংলো বাড়ি, যেখানে রাস্তা থেকে টানা কাঠের পাটাতনের ওপর হেঁটে দোতলা দিয়েই শুধু বাড়িতে ঢোকা যায়, তারপরে সেখান থেকে একতলায় যেতে হয়, এ যেন এক স্বপ্নের বাড়ি। ওখানে সমতল থেকে দিগন্ত-বিস্তৃত একের পর এক প্রকাণ্ড পাহাড় গুলো যখন প্রথম চোখে পড়ে তখন মনে হয় আদিমকালে সমতলের মানুষ গুলো যখন প্রথম পাহাড় দেখেছিল তখন নিশ্চয়ই ওরা ভেবেছিল সৃষ্টিকর্তা ওই পাহাড়ের ওপরই কোথাও বিরাজমান, তারপর বহুদিন বাদে পাহাড়ের চূড়া জয় করে হয়ত তাদের সেই ভুল ভেঙ্গে ছিল।

আবার পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রের জল যদি হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য শুকিয়ে যায়, তাহলে আমরা দেখব আকাশচুম্বী কোনো পাহাড়ের ওপর আমরা বসে আছি, সমুদ্রের ধারের শহরবাসী যারা হাতের কাছে নীল সমুদ্রের জল দেখে তারা দেখবে গভীর খাদ, ওরা বেশি ধারে যেতে ভয়ে পাবে আর যারা সবুজ বা ধূসর সমুদ্র দেখে তারা দেখবে ঢাল গুলো আস্তে আস্তে নেবে গেছে দূরে ভয়ংকর অন্ধকার গর্তের দিকে। আসলে সমুদ্রের জলের এই রঙের খেলা গভীরতা আর সূর্যের আলোর ভোজবাজি, চোখের কাছে সত্যি কিন্তু আসলে মিথ্যে, কারণ জলের কোনো রং নেই।

জল ভর্তি পৃথিবী গ্রহের সমুদ্রের এই বিভিন্ন পাহাড় গুলো তৈরি করেছে দ্বীপ বা দ্বীপপুঞ্জ, আবার সেখান থেকে হয়েছে দেশ বা মহাদেশ। দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি Atoll, যেগুলো প্রবালপ্রাচীর (Coral Reef) দিয়ে ঘেরা প্রবাল-দ্বীপ যার ওপর আছে হালকা মাটির স্তর আর বালি। সমুদ্রের মধ্যে হাজার হাজার মাইল ছড়িয়ে থাকা কয়েক হাজার ঢিপি, যার সবথেকে উঁচুটা হয়তো সমুদ্রের জল থেকে মাত্র পাঁচ মিটার উঁচু, একটা সমুদ্রের ঢেউ যাকে গ্রাস করতে পারে। কিন্তু ওই ঢিপি গুলো বুদ্ধি করে সৈনিকের মতো লক্ষ্য লক্ষ্য বছর ধরে ব্যারিকেড করে রেখেছে যেন রাজ-বংশজাত হাজার হাজার অন্য ঢিপিকে, যার ওপর এসে বসেছে মানুষ, সেখানে সভ্যতা থেকে সংস্কৃতি থেকে রাজনৈতিক সীমানাতে তৈরি হয়েছে সার্বভৌম রাষ্ট্র। সমুদ্রের কাছে এই ক্ষুদ্র ঢিপি-শক্তিকে ধ্বংসের অনেক অস্ত্রও আছে যেমন ঝড় ঝঞ্ঝা, সুনামি ইত্যাদি, কিন্তু সমুদ্রের অপার দয়া, সে মহা-শক্তিধারী রক্ষক স্বল্প-শক্তিধারী ভক্ষক নয়।

ভারতের খুব কাছে, দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারত মহাসাগরে অবস্থিত এই রকম এক Atolls’এর নাম মালদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জ। যাইহোক সেদিন মুম্বাই থেকে বেঙ্গালুরু হয়ে মালদ্বীপের রাজধানী Male শহরে পৌঁছতে ফ্লাইটে সর্বসাকুল্যে প্রায় সাত ঘণ্টা লেগে গেল। আমি অফিসের কাজ নিয়ে সপ্তাহ খানেকের জন্য হাজির এখন এখানে। আমার প্রথম তিন-চার দিন ছুটি আর আনন্দের অবসর, কিন্তু বাকি কাজের দিন গুলো আগেই বিক্রি করা আছে কোম্পানির কাছে কঠোর শরীর আর মগজের পরিশ্রমের জন্য, এ যেন রক্ত বেছে খাওয়া, অপুষ্টি প্লাস পুষ্টি, ইস ইকুয়াল টু জিরো।

এরোপ্লেন এসে নেবেছিল নীল সমুদ্রের মধ্যে মালদ্বীপের রাজধানী Male শহরের Airport Island’এ, সেখান থেকে আমাকে Ferryboat’এ চেপে যেতে হবে Male শহরে। পৌনে-দু কিলোমিটার লম্বা, এক কিলোমিটার চওড়া আর এক মিটার উঁচু এই শহর আর তার পরেই আবার সমুদ্র। এই Male শহরটা তৈরি হয়েছে চারটে আলাদা দ্বীপ নিয়ে, Central Island, Airport Island আর তা ছাড়াও আরো দুটো দ্বীপ। এখানে লোকের মুখে মুখে Hospital Island, University Island, এই সব নাম শুনে অবাক হতে হয়। 820 কিলোমিটার লম্বা আর 130 কিলোমিটার চওড়া সমুদ্রের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা প্রায় এক হাজার Island’এর এই দেশ। সমুদ্রের স্বচ্ছ জলে লক্ষ্য লক্ষ্য মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে, বড় বড় বন্য মাছ গুলোর সাথে চোখাচোখি হলে, ওদের দেশে এসে ওদের বিরক্ত করার জন্য যেন বিব্রত হতে হয়। দূর কোনো Island’এ ব্যবসাদার, মুদি দোকানদারটা নিজের Boat নিয়ে রাজধানী-Island থেকে ব্যবসার মালপত্তর কিনে একা একা নিজের Boat চালিয়ে এবার বাড়ি চলল। ওর বাড়ি পৌঁছতে দুদিন সময় লাগবে, রাস্তায় ও মাছ ধরে Hotplate’এ রান্না করে খাবে, আবার মোবাইলেফোনে গল্প করবে, satellite TV দেখবে, ওর কেবিনটাতে একটা এয়ারকন্ডিশন লাগানো আছে, আর সুন্দর কেবিনটা রঙিন কাঁচ দিয়ে মোরা। বাজার অঞ্চলে কয়েক মিনিটের আলাপে আমাকে ওর Boat’টাতে নিয়ে গিয়ে, ও সব কিছু আনন্দ করে দেখাল আর বলল ওর ছেলে নাকি ইন্ডিয়াতে কলেজে পরে। ছোটো বেলায় পড়াশুনা না করলে গুরুজনরা ব্যঙ্গ করে বলতো, ‘লিখিবে পরিবে মরিবে দুঃখে, মৎস্য ধরিয়া খাইবে সুখে’, এ কথা এখানে ব্যঙ্গাত্মক বলা যেত না। এই বাবা আর ছেলে কে সফল তা আমার জানার দরকার ছিল না, কারণ আমার জীবনেও হয়তো ঠিক ‘যেটি নেই শুধু সেটিই  চাই’।

এখানে পৌঁছে সঠিক জানতে পারলাম যে আমাদের কাজ শুরু হতে আরো চার দিন দেরী, অর্থাৎ এই চার দিন আমার ছুটি। কোম্পানির যে ছেলেটা আমার হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিল, ও ছিল শ্রীলঙ্কার বাসিন্দা। এখানে অফিস, দোকান আর ঠিকাদারদের অধীনে প্রচুর ভারতীয়, বাংলাদেশী আর শ্রীলঙ্কার কর্মচারী। যদিও মালদ্বীপের বাসিন্দারাও নানান ব্যবসা বাণিজ্য আর সরকারী অফিসে কাজ করে, কিন্তু এদেশের লোকসংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম। কয়েক দশক আগেও ওরা যথেষ্ট গরিব ছিল, কিন্তু হালে বিদেশী বড় বড় Hotel & Tourism Business House’গুলোর সাথে নিজেদের দেশের ছড়িয়ে থাকা দ্বীপ গুলোতে যৌথ-উদ্যোগে ব্যবসা করে এই দেশের সরকার একপ্রকার অর্থনীতির ভোল বদলে দিয়েছে। এখন মালদ্বীপ বিমান বন্দরে প্রত্যেক দিন অসংখ্য Commercial আর Chartered Jet Plane নামে ওঠে, মস্ত বড় বড় Passenger জাহাজ আসা যাওয়া করে ওই দেশের বন্দর গুলোতে, আর দেশের ভেতর দূর দূরান্তে এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে সমুদ্রের জলে বিদেশী Tourist নিয়ে ছুটে বেড়ায় শত শত ছোটো বড় Luxury Speedboat। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার লোক ওদের Tourism Industry’তে কাজ করে, গরিবি এই দেশে আজ আর নেই।

Companyর ছেলেটা আমাকে একটা Local SIM Card দিল আর বলল,

– আমি রাতে এসে তোমাকে বাইরে Dinner করতে নিয়ে যাব, এখানে রেস্টুরেন্টের এর খাবার খুব ভালো আর সস্তা

— ঠিক আছে তাহলে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব

— তুমি যদি এই দ্বীপের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে চাও তো একা বেরিয়ে পরতে পারো, আমি তোমাকে ফোন করে নেব, এইটুকুনিতো জায়গা, তুমি যেখানে থাকবে আমি সেখান থেকেই তোমাকে মোটরবাইকে তুলে নেব

— ঠিক আছে

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ও রাতে কোনো অফিসের কাজে আটকে গেছিল, আর আমাকে ফোন করে ও আসতে পারবেনা জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলো। আমি হোটেলের খাবার না খেয়ে বাইরে খাব বলে বেরিয়ে পরলাম। দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে Male দ্বীপটাকে হেঁটে হেঁটে জয় করে দুবারই আমি সমুদ্রের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলাম। ঘণ্টা খানেক এদিক ওদিক ঘুরে আমি বুঝেসুঝে একটা সুন্দর মাঝারি খরচার রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেতে ঢুকলাম। বড় জয়গাটাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু লোক বসে ছিল, আমি নিজের পছন্দ মতো একটা টেবিল নিয়ে বসলাম। Blue-Jeans আর ওই প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা T-Shirt পড়া একটা মেয়ে এসে আমার টেবিলের সামনে দাঁড়াল। মেয়েটা শ্যামবর্ণা, সুন্দর তীক্ষ্ণ মুখ-চোখ, ছেলেদের মতো কাটা ঢেউ খেলানো সুবিন্যস্ত চুল, শিকারি বন্য জানোয়ারের মতো ছিপছিপে লম্বা অতি আকর্ষণীয় একটা দেহ, এক কোথায় ওর মধ্যে এমন কিছু আকর্ষণ ছিল যাতে যেকেউ একবার দেখে আবার ওর দিকে ফিরে তাকাবে। অসম্ভব দামী একটা বিদেশী পারফিউমের গন্ধে জায়গাটা ভরে গেল, একটা রেস্টুরেন্টের Waitress’এর কাছে এটা একদম অপ্রত্যাশিত ছিল। আমার মনে পড়ল আমি বেশ কয়েক বছর আগে France’এর Paris Airport থেকে এই রকম একটা দামী পারফিউমের বোতল কিনে শুধু মাত্র ওই বোতল হাতে নিয়েই, Duty-free Shop থেকে আর কিছু না কিনতে পেরে একপ্রকার সর্বস্বান্ত হয়ে কোলকাতায় ফিরে ছিলাম। তবে ওই জিনিসের মহত্ত্ব এই যে ও বোধহয় কোনদিন শেষ হয়ে না, আজও বোতলের মাথাটা টিপলে যেটুকু স্প্রে হয়ে তাতে একটা সারা দিন বড়লোক সেজে চালিয়ে দেওয়া যায়।

মেয়েটা আমাকে একটা Menu-Card দিয়ে কিরাম যেন গম্ভীর মুখ করে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি Order করতে ও আমার খাবারটা  দিয়ে ওই একই ভঙ্গিমায় একটু দুরে দাঁড়িয়ে রইলো আর আমার দিকে মাঝে মধ্যে তাকিয়ে দেখছিল, বোধহয় এই জন্য যে যদি আমার আর কিছু দরকার লাগে। আমিও ছোটো ছেলেরা যেমন মায়ের ভয় যা দেওয়া হয় তাই কিছু না বলে খেয়ে নেয়ে, সেই ভাবে Dinner শেষ করলাম, পরিতৃপ্তি বোধহয় সেদিন আমার জিহ্বার স্বাদের রাস্তা না ধরে চোখের স্বাদের দিক দিয়ে বেশি এসেছিল। আমি ওকে বেশ বড় অঙ্কের Tips দিলাম, ও হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে অপ্রত্যাশিত ভাবে হাসল, সমুদ্রের ভেঙ্গে পরা ঢেউয়ের সাদা ফ্যানার মতো ওর সুসজ্জিত দাঁত গুলো ঝকঝক করে উঠলো। আশ্চর্য দাম্ভিকতা ছিল ওর হাসির মধ্যে, আমার ওকে ভয় একটু পেতে ভালো লাগছিল। ওখান থেকে বেরিয়ে আমি হাঁটতে হাঁটতে হোটেলে ফিরে এলাম, ঘুমিয়ে পরা অবধি ওর কথাই আমার মাথায় ঘুরছিল।

পরের দিন দুপুরে বেড়াতে বেরিয়ে এখানকার রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনের প্রকাণ্ড চাতালটার কাছে সমুদ্রের ধারে কালকের ওই মেয়েটাকে একা বসে থাকতে দেখলাম, ও আমাকে দেখতে পায়নি। যা হয় হবে এই ভেবে আমি ওকে গিয়ে বললাম,

— Hello, তুমি আমাকে চিনতে পারছ?

ও আবার দাম্ভিক ভাবে হাসল আর মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল, তারপর আবার চুপ করে থাকলো আমি কিছু কথা বাড়াবার জন্য বললাম,

— তুমি কি এই মালদ্বীপের বাসিন্দা?

— হ্যাঁ, তুমি?

— আমি India থেকে এসেছি, আমাদের কোম্পানি এখানে ব্যবসা করে, তুমি কখনো India গেছো?

— না, আমার বাবা গেছে। তুমি Dhivehi ভাষায় কথা বলতে পারো?

Dhivehi ওদের Maldivian ভাষার আর এক নাম

— না, একদম নয়, তুমি তো ভালোই ইংরেজি বলো

— একটু একটু বলতে পারি

— তোমার নাম কি?

— Anju, তোমার?

আমি আমার নাম বললাম

— তোমার আজকে রেস্টুরেন্টে কাজ নেই?

— আমার ছুটি, তিন-চার দিন ছুটি, আমি কালকে বাড়ি যাব তাই ছুটি নিয়েছি

— তোমার বাড়ি কোথায়?

— অন্য একটা দ্বীপে, এখান থেকে Ferryboat’এ প্রায় চার ঘণ্টা লাগে যেতে

— চলো আমি তোমাকে কফি খাওয়াই, তোমার সাথে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগছে

ওকে ইশারায় আসতে বলতে ও গম্ভীর ভাবে আমার সাথে হাঁটতে লাগলো। আমার মনে হল ও কথা কম বলে, কিন্তু নিঃসন্দেহে ও একটা দারুণ Interesting চরিত্র। আমরা রাস্তার ওপারের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম। আমি বললাম,

— তুমি Lunch করেছ?

— না

— তাহলে আরো কি খাবে বল, আমিও Lunch করিনি, আমরা দুজনেই কিছু Order করি, চলো 

ও গম্ভীরভাবে Menu Card দেখতে লাগলো। আমার পয়সায় Lunch করতে ওর কোনো আপত্তি নেই দেখে আমারও একটু সাহস বেড়ে গেল, আমি আরো একটু ভবিষ্যতের কথা ভেবে বললাম,

— তোমার বাড়ি যেখানে সে দ্বীপটা নিশ্চয়ই খুব সুন্দর?

— খুব সুন্দর

— তোমাদের ওখানে থাকার কোনো হোটেল আছে?

— ছোটো হোটেল আছে, Male’এর মতো বড় কিছু নেই?

— তুমি কি হোটেলে থাক?

— আমাদের কোম্পানি থেকে হোটেলের ব্যবস্থা করেছে, আমারও আগামী তিন দিন ছুটি আছে, তারপরের দিন থেকে আমাদের কাজ শুরু হবে। আমরা হয়তো আরো সাতদিন এখানে থাকবো, তারপর থেকে প্রত্যেক দু-এক মাসে আমাকে এখানে একবার আসতে হবে।

আসলে এর সব কথা সত্যি ছিল না কিন্তু একটা বিদেশী সুন্দরী মেয়েকে প্রথম আলাপেই যদি বলি আমি সাত দিন বাদে চলে যাব আর এখানে নাও আসতে পারি তাহলে সে আমাকে বাস্তবিকই আর গুরুত্ব দেবে না। আমি বললাম,

— আমি এই দেশটা একটু ঘুরে দিখতে চাইছিলাম, তোমার সাথে তোমাদের দ্বীপে যেতে পারলে আমার মালদ্বীপ সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা হতো। যেমন তোমাদের দেশের গ্রাম গুলো কেমন বা তোমরা কেমন ভাবে থাকো, এই সব কিছু। 

আসলে এই কথাগুলো আবার আমার কাছে সত্যি ছিল। দূর বিদেশে গিয়ে সেই দেশের মানুষের সঙ্গ পাওয়া বা তাদের মতো থাকা বা তাদের সাথে বসে সেই দেশের আঞ্চলিক কোনো খাবার খাওয়া, এই গুলোই ভিনদেশী পর্যটকের সবথেকে বড় প্রাপ্তি। ক্ষণিকের আলাপে কারোর বাড়ি গিয়ে থাকা যায় না ঠিকই কিন্তু তাদের সাথে বসে খাওয়া যায় বা বিশেষ করে তাদের পছন্দের কোনো রেস্টুরেন্টে তাদের নিয়ে গিয়ে খাওয়ানো যায়। McDonald’s ‘এ খাওয়া আর Granite দিয়ে মোড়া Concrete’এর তৈরি হোটেলে থাকাটা মহাসাগরের মধ্যেখানের এই Atolls ভ্রমণকে কলঙ্কিত করা ছাড়া আর কিছুই নয়, সে নিউইয়র্ক কিংবা টোকিও বেড়াতে গেলে ঠিক ছিল। তারপর যে সঙ্গিনীটি এই পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে তার সাথে হয়তো জাহান্নাম যাবারও লোভ সামলানো যেত না। ও বলল,

— তুমি আমার সাথে কালকে সকালে যাবে? আমাদের দ্বীপে তোমার হোটেলের Booking করে দিলে আমি Commission পাব, তাতে আমার নিজের যাওয়া-আসার খরচা উঠে আসবে

এই বলে ও আবার হাসল, আমি জানতাম যে আমি কাল অবশ্যই ওর সাথে যাচ্ছি। ওকে উত্সাহ দেবার জন্য আমি বললাম,

– তাহলে তো খুব ভালো হল, এতে তোমার আর আমার দু-জনেরই লাভ হবে, তোমার বাড়িতে কে কে আছে? 

— আমার বাবা-মা, ভাই

— দারুণ, তাহলে কি Gift দিলে তোমার বাবা খুশি হবেন?

– হয়তো একটা ভালো Scotch Whisky, তুমি পারবে না অনেক দাম

এই বলে ও আবার হাসল, ওর অতি সুন্দর এই হাসিটা হঠাৎ এসে আবার হঠাৎ মিলিয়ে যেত, ও গম্ভীর ব্যক্তিত্বের মানুষ, আন্দাজ বাইশ-তেইশ বছরের একটা মেয়ের এই গাম্ভীর্য ওকে সাধারণের থেকে আলাদা একটা পরিচয় করে দিত। নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে ঢেকে রেখে সহজ-প্রাপ্য একটা হাসিকে উপহারের মতো করে লোকের কাছে পেশ করত, বেশি বার হাসলে নিজেকে কেমন যেন ওর কাছে ঋণী মনে হতো, অদ্ভুত একটা কায়দা এটা। আমি বললাম,

— আমি চেষ্টা করব, হয়তো পারবো

বিকালে হোটেলে ফিরে আমার অফিসের শ্রীলঙ্কার Colleague’এর সাথে যোগাযোগ করলাম। এই দেশে পাঁচতারা হোটেল ছাড়া অন্য কোথাও Alcohol পাওয়া যায় না, এক মাত্র Airport Island’এর Bar’গুলোতে এইসব সহজলভ্য। আমাকে ও বলে রেখেছিল যে দরকার হলে ওর থেকে Scotch Whisky নিতে, আমাদের অফিসের লোকেরা প্রায়শই বিদেশ যাওয়া-আসা করে আর Airport Duty-Free Shop থেকে Alcohol কিনে নিয়ে আসে। সব কথা জানাতে ও বলল যে ও দ্বীপটার নাম জানে আর আমার যাওয়াতে কোম্পানির দিক থেকে কোনো অসুবিধা নেই কারণ এদেশে Crime নেই বললেই চলে, আমি যেন ফোনে ওর সাথে যোগাযোগ রাখি, আর কাজ শুরু হবার দিন সকালে চলে আসি। Whisky ‘টা কোনো ব্যাপার নয়, ও বলল রাতে আমার হোটেলে দিয়ে যাবে, দামও অনেক কম যেহেতু Duty-Free Shop থেকে কেনা।

পরের দিন সকালে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে একটা Ferryboat’এ করে নীল সমুদ্র আর ছোটো ছোটো অনেক দ্বীপ পেরিয়ে আমরা ওদের দ্বীপে পৌঁছলাম। দৈর্ঘ্যে আর প্রস্থে হয়ত তিন-চার কিলোমিটার এই দ্বীপটার, একদিকে দাঁড়িয়ে আরো দুটো দ্বীপের জনবসতি দেখতে পাওয়া যায়। এখানে এক মাত্র জলপথেই যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে । Passenger-Jetty’টা থেকে বেরিয়ে একটু হাঁটলেই ওই দ্বীপটার  প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছে যাওয়া যায়, ওখানেই ওদের বাজার দোকান,সরকারী দফতর ইত্যাদি। Anju আমার থাকার জন্য আগে থেকে এই অঞ্চলেই একটা হোটেলের ব্যবস্থা করেছিল। বাজারের শেষপ্রান্তে আমার সাদামাটা হোটেলের ঘরটার সামনে থেকেই Beach শুরু হয়েছে।

Boat’এ আসার সময় ও আমাকে বলছিলো যে ওদের সবথেকে কাছে, মাত্র দু-কিলোমিটার দূরে যে আরেকটা দ্বীপ সেটাই নাকি ওই অঞ্চলের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একসাথে অনেক গুলো দ্বীপের সদর-দ্বীপ। প্রধান সরকারী কার্যালয়, হাসপাতাল, কলেজ সবকিছুর জন্যই ওদের ওখানে যেতে হয়। Boat থেকে নেমে একটা Taxi নিয়ে ও আমাকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে গাড়িতে বসেই দাঁড়িয়ে থাকা Bellboy’কে আঞ্চলিক Maldivian ভাষায় কিছু বলল, আর আমাকে বলল,

— তুমি ওর সাথে যাও, ও সব ব্যবস্থা করে দেবে, আমি সন্ধেবেলা আসব

— ধন্যবাদ, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকব

মাত্র দুতলা এই হোটেলটা ছিল খুব সাধারণ আর খুব সুন্দর। কাঁচের জানলা খুলে চুপ করে দাঁড়িয়ে সমুদ্রতটের বুকে ভেঙেপড়া একটানা ঢেউয়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, আমি একা দাঁড়িয়ে আমার বন্ধুর বন্ধুত্বের, ওদের দেশের লোকের আতিথেয়তার আর সৃষ্টিকর্তার এই অভাবনীয় সৃষ্টির প্রশংসার আবেগপ্রবণ চিন্তায় ডুবে ছিলাম। দুপুর প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিল তাই আমি হালকা কিছু খেয়ে একটু বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়েই পরলাম।

ঘুম থেকে উঠে চোখ খুলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখি সূর্য সমুদ্রের দিগন্তরেখায় ওপর পশ্চিমে ঢোলে পরেছে, আমি বেরোনোর জন্য প্রস্তুতি শুরু করলাম। Beach’টাতে কয়েকটা Plastic’এর চেয়ার-টেবিল পেতে রাখা ছিল, ওখানে বসে এক Cup Coffee খেয়ে সমুদ্রের ধার ধরে আনমনে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করলাম। ওই অঞ্চলটার সাথে Tourism’এর কোনো সম্পর্ক নেই, তাই সমস্ত Beach’টাতে দূরে দূরে কিছু লোক ছাড়া আমি কাউকেই দেখতে পেলাম না। যে দেশে সবার বাড়ির উঠোনই সমুদ্রতটে সেখানে বাস্তবিকই লোক দেখতে হলে কারুর বাড়ির উঠোনে গিয়ে হাজির হতে হবে, শুধু সমুদ্রতট বলে নিশ্চয়ই কোনো লোক পাওয়া যাবেনা। আমার সবথেকে আকাঙ্ক্ষিত ফোনকলটা এলো।

— আমি এখন তোমার হোটেলে আসছি, তোমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসব

— OK, তুমি এস, আমি তোমার জন্য হোটেলের Entrance‘এ অপেক্ষা করব

কিছুক্ষণের মধ্যেই Anju একটা Scooty নিয়ে এসে হাজির হলো। একটা Fed-Jeans’এর প্যান্ট আর গুঁজেপরা কলার দেওয়া Shirt পরে, Riding-Glass চোখে দিয়ে ওকে একটা ডানপিটে কিশোরীর মতো দেখাচ্ছিল, ওর চোখে মুখে একটা বেপরোয়া ভাব, সুন্দর পেটানো দেহটাতে বন্য জানোয়ারের লুকানো শক্তি। আমার মনের অনেক গভীরে আমি হয়ত ওকে অবিশ্বাস করতাম, তারপরে আবার ওপরের স্তরে নিশ্চয়ই যথেষ্ট আকর্ষণ অনুভব করতাম। 

— তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে

আমার এই অতি সাধারণ কথাটা ওর নরম মন ছুঁয়ে গেল, ওর চোখের দৃষ্টির বন্যতা চলে গেল, ও লাজুক ভাবে চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো,

– আমি কি তোমার পিছনে Seat’এ বসবো?

– বসো

— আমি তোমার বাড়ির জন্য কিছু Gift নিয়ে যেতে চাই, আমি Market থেকে কিছু কিনতে চাই, কি কিনব?

— Scotch Whisky’র  বোতলটাই যথেষ্ট

— তোমার বাড়িতে কে কে আছে?

— গেলেই দেখতে পাবে

পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দ্বীপটাতে সমুদ্রের ধার ঘেঁসে ছড়িয়ে আছে ছোটো ছোটো বসত বাড়ি গুলো, দ্বীপের জনসংখ্যা সাথে সামঞ্জস্য বজায়ে রেখে কয়েকটা গাড়ি বা স্কুটার, মোটরসাইকেল চোখে পড়ল। রাস্তা গুলো সবই এদিক ওদিক দিয়ে সমুদ্রের ধারে গিয়ে শেষ হয়েছে। সমস্ত দ্বীপটাতে দোতলার চেয়ে উঁচু কোনো বাড়ি চোখে পড়ল না। দ্বীপের অন্য প্রান্তে সমুদ্র থেকে কয়েকটা বাড়ির পরেই ওদের একতলা টিনের ছাতের অতি সাধারণ একটা বাড়ি। আমার জ্ঞানের মাপকাঠির বিচারে আমি বুঝলাম ওদের দেশের অর্থনীতির বিচারে ওরা নিম্নমধ্যবিত্ত বলা যায়, যদিও আমি আগে Male শহরে থাকতেই সেকথা আন্দাজ করে ছিলাম, কিন্তু প্রকৃতির স্নেহধন্য এই মানুষগুলো মনের কোনো গরিবি নিয়ে ছোট থেকে বড় হয়েনি।

ওর মা বাবা আর ছোট দুটো কিশোর ভাই ছাড়াও একটা দু-তিন বছরের ছোট্ট Cute মেয়ে ছিল ওদের বাড়িতে। Anju বলল,

– এটা আমার মেয়ে, আমার বরের সাথে দু বছর আগে Divorce হয়ে গেছে

এই ব্যাপারটা আমার হিসাবের বাইরে ছিল কিন্তু তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না, বরঞ্চ আমি যে ছোট্ট মেয়েটার জন্য একটা Gift নিয়ে আসেনি এটাই তখন আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। পরে আমি জানতে পারি যে Guinness Book of World Records অনুযায়ী, ছোট্ট এই মালদ্বীপ দেশটার Divorce Rate সারা পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে বেশি।

ওর বাবা মৎস্য শিকারি, ভাইরা স্কুলের ছাত্র আর মা, বাবার মাছের ব্যবসার একজন সহকারী, বাড়ির বড় মেয়ে রাজধানী Male’তে রেস্টুরেন্টের Waitress আর স্বাধীনচেতা এক যুবতী মেয়ে, এই হল আমার বোঝা ওদের পারিবারিক সংগঠন।

অন্ধকার হয়ে গেছিল, ওর বাবা আর আমরা দুজন বাড়ির পিছনের নির্জন দালানে বসে Scotch Whisky খাওয়া শুরু করলাম, সুস্বাদু মাছের কিছু পদ ছিল আমাদের জন্য। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরাজি দিয়ে আমার কাজ ভালই চলে যাচ্ছিল, ওনার সাথে কথা বলে জানলাম যে ওনার এক বোনের আন্দামান-নিকোবার দ্বীপপুঞ্জের কোনো বর্ধিষ্ণু পরিবারের লোকের সাথে সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়েছে, প্রশ্নে করে আরো জানতে পারলাম যে ওরা দ্বীপপুঞ্জের মানুষেরা নাকি অন্য দ্বীপপুঞ্জের মানুষের সাথে সম্বন্ধ করে বিয়ে করে, সেটা ওদের রীতি। ওরা মনে করে ওদের সাথে দেশ বা মহাদেশের মানুষের মনের আর সংস্কৃতির মিল নেই, ওরা নাকি আলাদা। আমি ওনার কথা শুনে আশ্চর্য হলেও ওনার কথা আমার যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়েছিল। 

অনেক অনুনয় বিনয় করে আমি ওদের জন্য Dinner কেনার পয়সা দেবার অনুমতি পেলাম, ওর ভাইরা অবশ্য কিনে আনার দ্বায়িত্ব নিলো। ওই আদিবাসী পরিবারে আমার মত এক অজানা বিদেশীর উপস্থিতি, ওদের বড় মেয়ের স্বাধীনতা আর যোগ্যতার ওপর পরিবারের অস্বাভাবিক গর্ব, অকৃত্রিম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর Scotch Whisky’র আমেজ পরিবেশটাকে কানায় কানায় আবেগে ভরিয়ে তুলেছিল। এক্ষেত্রে বোঝা দরকার যে আদপে Alcohol বর্জিত ওই সমাজে Divorced মেয়েটার অপরিচিত ছেলে বন্ধু আর বাবার সাথে বাড়িতে বসে সসম্মানে মদ্যপান করাটা ঠিক বা ভুলের অনেক ঊর্ধ্বে এক আদিম আদিবাসী জীবনের Gender Equality’র পরিচয় রেখেছিল আর আমার মনের গভীরে ওদের সমাজ ব্যাবস্থার প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধার উদ্রেক করেছিল।

এইভাবে কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর ও বাবার অনুমতি নিয়ে আমার সাথে বাড়ি থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে সমুদ্রের Beach ধরে হাঁটতে লাগলো। অকারণে কয়েকবার হোঁচট খেয়ে ও আমাকে ধরে দেহের ভারসাম্য ঠিক রাখল, যদিও আমার হিসাবে আমরা কোনো অর্থেই মাত্রাতিরিক্ত কিছু খায়নি । বালির ভিতর আকাশ ভরা জ্যোৎস্নার আলোতে জনমানব শূন্য সমুদ্রের ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা ছোট্ট খাদের সামনে এসে পৌঁছলাম, ওর হাত ধরে ওকে সাহায্য করতে গেলে ও হাত ছাড়িয়ে নিলো,

— আমার গায়ে হাত দিও না

— Very Sorry, আমি ভাবলাম যে তোমার ভারসাম্য রাখতে সুবিধা হবে

– তোমার সাহস হয় কি করে, আমার গায়ে হাত দিতে?

– Anju please, রাগ করনা, তুমি আমাকে ধরে একটু আগে হাঁটছিলে বলে আমি ভাবলাম হয়ত আমি তোমার হাত ধরলে, তোমার সুবিধা হবে

ওর চোখে মুখে অত্ভূত যেন জানোয়ারের হিংস্রতা ফুটে উঠলো, এত রাগ দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম। ও কেঁদে উঠলো, কেমন একটা অজানা কষ্টের আওয়াজ ছিল ওর কান্নার মধ্যে, আমি হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। হঠাৎ ও হাসল, ওর মুক্তর মতো সুন্দর দাঁত গুলো জ্যোৎস্না আলোতে ঝকঝক করে উঠলো, আমি বুঝলাম আমি বোকা বনে গেছি।

— তুমি ভয়ে পেয়েছিলে?

— আমি তোমাকে ভয়ে পাই তুমি তো জানো, তোমাকে সবাই ভয়ে পায়ে তাই না?

ওর ভিতরে কথাও একটা জংলী জানোয়ারের সৌন্দর্য ছিল, আমি ওর সম্পর্কে কিছুই জানতাম না কিন্তু আমার মনের অবিশ্বাসের ভিত নড়ে গেছিল, আমি ওকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম।

মসৃণ গাল দুটোতে চোখের জলের দাগ, ও আমাকে গালে হাত দিয়ে দেখতে বলল, আমি দিইনি। সত্যি হয়তো ওর কোনো গভীর দুঃখ আছে, যার এক ঝলক ও আমায় দেখাল আর আমি বাকি সারা জীবনের জন্য সেটা মনে রাখলাম। আবার হয়তো বা ওর অদ্ভুত অভিনয় করার ক্ষমতা আছে, আমি ঠিক জানি না। আমি ওর হাতের আঙ্গুলের মধ্যে নিজের আঙ্গুল দিয়ে মুঠো করে ধরে ছিলাম, আমার ভয় ছিল ওর জংলী স্বভাবকে, আমার নিজের আদিম চাহিদাকে, তারাও আবার একে অপরকে বিশ্বাস করতে শুরু করেনি তো?

সেদিন রাত্রের খাওয়া-দাওয়ার পর ওর ভাই আমাকে Hotelএ ছেড়ে দিলো। পরিকল্পনা মতো পরের দিন সকালের Ferryboat’এ আমার একা Male শহরে ফিরে যাবার কথা। আমি ততক্ষণে Jetty’তে পৌঁছে গেছি, Anju এসে আমার সাথে দেখা করে বলল,

– তুমি আজকে থেকে গেলে আমরা নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে যেতাম

– আমাকে দুপুরের পর অফিসে Report করতে হবে, কাল থেকে আমাদের কাজ শুরু হবে তাই, নয়তো আমি থেকেই যেতাম

– আমি কালকে ফিরব, তুমি কি কাল রাত্রে আমাদের রেস্টুরেন্টে Dinner করতে আসবে

— আমি আজকেও ওখানেই Dinner করতে যাব

— না আজকে যেও না 

— কেন?

— আজকে আমি থাকব না, আজকে তুমি যেও না

আমার ওর কথা শুনে হাসি পেল, যদিও আমি বুঝেছিলাম যে আমি আজকে যাবনা।

এর পরে আরো চার দিন আমি মালদ্বীপে ছিলাম। রোজ রাত্রে ওখানে Dinner করতে যেতাম আর যত টাকার খাবার খেতাম ওকেও তত টাকা Tips হিসাবে দিতাম, এই ভেবে যেন আমরা দুজনে একসাথেই খাচ্ছি। আমার খাবারের Menu’ও একপ্রকার ওই ঠিক করত। কিন্তু মালদ্বীপে আমার মেয়াদ ফুরিয়ে আসছিল।

নির্ধারিত দিনের সকালে আমি মালদ্বীপ Airport Island’এর  International Departure Lounge’এ একা একা অনেক্ষন বসে ছিলাম। বাইরে প্রচন্ড ঝড়ো হওয়া থাকার জন্য প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা Flight Delayed ছিল। Anju’র কাছ থেকে আমি আগের দিন রাত্রে বিদায় নিয়েছিলাম। Airport থেকে আমি ওকে আমার Flight Delay হবার কথা বলিনি, ও হয়তো ভাবছিল আমি ততক্ষণে মুম্বাই ফিরে গেছি কিন্তু আমি ওখানেই ছিলাম, আমি ফিরে এসেও অনেক দিন ওখানেই ছিলাম। Flight Take-Off’এর পর অনেক উঁচু থেকে দেখলাম ঝড়ের তাণ্ডবে সমুদ্র ফুঁসছে আর হিংস্র জানোয়ারের থাবার সাংঘাতিক নখ গুলোর মধ্যে মায়ের আদরে আদরে থাকা শিশুর মত নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে মালদ্বীপ। Air-Hostess’কে ডেকে আরেকটা Large Peg Whisky দেবার জন্য অনুরোধ করলাম, ভাবলাম বাকি সময়টা ঘুমিয়েই কাটাব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার কয়েকটা লাইন বার বার মনে পড়ছিলো, “হায় রে হৃদয়, তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়”।

–সমাপ্ত–

ছোটগল্প

মালদ্বীপ দ্যা এটলস

মালদ্বীপ, দ্যা এটলস পাহাড়ের কোলে ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি, ভাবতেই বাঙালির মন চলে যায় দার্জিলিঙের পাহাড়ে। দোতলা বা তিনতলা একটা সেকেলে...
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x